সহকর্মীদের ‘অপকর্মে’ বেদনাহত পিটিআই প্রশিক্ষকের আত্মহত্যাচেষ্টা
৭ মার্চ ২০২০ ২০:৩২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) একজন প্রশিক্ষক আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এর আগে তিনি ফেসবুকে কয়েকজন সহকর্মীর বিরুদ্ধে ওই ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণার্থীদের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে বিচার দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লেখেন। প্রশিক্ষণার্থী ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারার বেদনা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে তিনি স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন।
অভিযুক্ত প্রশিক্ষকরা ‘ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির’ অভিযোগ নাকচ করে বলেছেন, ইনস্টিটিউটের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব থেকে আবেগপ্রবণ হয়ে তাদের সহকর্মী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন। তবে অভিযোগ সত্য উল্লেখ করে এবং অভিযুক্তদের বিচার চেয়ে শনিবার (৭ মার্চ) বিকেলে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় ওই ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছেন প্রশিক্ষণার্থীরা।
আত্মহত্যার চেষ্টা করা প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়া চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার তুলাবাড়িয়া এলাকার মৃত অমূল্য রতন বড়ুয়ার ছেলে। নবীন প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির আইসিটি শাখার প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।
দেবব্রত বড়ুয়ার জ্যাঠাত ভাই শরণ বড়ুয়া সারাবাংলাকে জানান, শুক্রবার রাতে নগরীর কালামিয়া বাজার এলাকার বাসায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে আমেরিকা থেকে এক নিকটাত্মীয় ফোন করে একই বাসায় আরেকটি কক্ষে ঘুমন্ত স্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা দরজা ভেঙে প্রায় অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি বর্তমানে নগরীর ও আর নিজাম রোডে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলেছেন বলে জানিয়েছেন শরণ বড়ুয়া।
দেবব্রত বড়ুয়ার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের টাইমলাইনে শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে লেখা পোস্টে তিনি বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে তিন সহকর্মী প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু কথা বলেন। তিন জন হলেন— পিটিআইয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের প্রশিক্ষক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন, চারু ও কারুকলা বিভাগের সবুজ কান্তি আচার্য এবং সাধারণ শিক্ষা বিভাগের মো. জসীম উদ্দিন। আত্মহত্যাচেষ্টার আগে দেওয়া একই বিষয়ে বেশ কয়েকটি স্ট্যাটাসে তিনি প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথোপকথনের কয়েকটি স্ক্রিনশটও পোস্ট করেন।
ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১১ সালের ফারুক হোসেন পিটিআইতে বদলি হয়ে আসার পর প্রশিক্ষণার্থী ছাত্রীদের টার্গেট করে বিভিন্নভাবে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ শুরু করেন। কাউকে বেশি নম্বর দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, কারও প্রেমের সম্পর্ক ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে এ অপকর্ম করে আসছেন। ইনস্টিটিউটের আইসিটি ল্যাবে নিয়ে ৫০ জনেরও বেশি নারীকে ফারুক ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ তার।
জানতে চাইলে ফারুক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বিব্রত হয়েছি। উনি আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ফেসবুকে লিখেছেন, একটিও যদি প্রমাণ করতে পারেন, আমি চাকরি ছেড়ে দেবো অথবা যে শাস্তি দেন, সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব। উনি খুবই ইমোশনাল মানুষ। একই জায়গায় কাজ করতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি হয়। কিন্তু উনার সঙ্গে আমার এমন কোনো দূরত্ব নেই যে এই ধরনের কথাবার্তা বলে উনি আমার সম্মানহানি করতে পারেন। আমি উনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি। আসল ঘটনা হচ্ছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান আমাদের দিয়ে অনেক কাজ করান। যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছি বলেই করান। এতে উনি ঈর্ষান্বিত হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।’
জসীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিরতির সময় নারী প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত শ্রেণিকক্ষ, করিডোর ও আঙ্গিনায় কথা বলেন এবং সম্পর্ক তৈরি করে পরবর্তী সময়ে ‘অপকর্ম’ করেন। ২০১৮ সালে জসীম ইনস্টিটিউটের ‘প্রীতিলতা হোস্টেলে’ ঢুকে এ ধরনের ‘অপকর্ম’ করেন।
তৎকালীন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত হোস্টেল সুপার তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় উপপরিচালক মহোদয়কে লিখিত অভিযোগ করে তাকে হোস্টেলের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন। জসীম তার কথা না শুনলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবেন এবং কথামতো কাজ করলে অনেক বেশি নম্বর দেওয়া হবে বলে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলেন।
এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জসীম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ২৫ বছর ধরে চাকরিতে আছি। কেউ কোনোদিন আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের নোংরা কোনো অভিযোগ তুলতে পারেনি। কোনো প্রমাণ নেই, মৌখিক কিংবা লিখিত কোনো অভিযোগ নেই। উনি কিসের ভিত্তিতে এত গুরুতর অভিযোগ করেছেন, উনিই বলতে পারবেন। আর আমার দ্বারা কোনো নারী যদি ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির শিকার হতেন, তাহলে তিনিই তো আত্মহত্যা করতে পারতেন। উনাকে (দেবব্রত) আত্মহত্যা করার দায়িত্ব কে দিয়েছেন?’
সবুজের বিরুদ্ধে দেবব্রত অভিযোগ করেছেন, তিনি কক্সবাজার পিটিআই থেকে ২০১৪ সালে পটিয়ায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি চারু ও কারুকলার প্রশিক্ষক হিসেবে মেয়েদের অঙ্গসৌষ্ঠবের শৈল্পিক বিশ্লেষণ এবং শাড়ি বা কী ধরনের পোশাকে কাকে ভালো দেখাবে, সে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নারীদের সঙ্গে যৌন হয়রানিমূলক কথাবার্তা বলে দুর্ব্যবহার করেন।
সবুজ কান্তি আচার্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি চাকরিতে আছি আর তিন বছর। আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ কেন আনা হলো, বুঝতে পারছি না। আমাদের ইনস্টিউটে গ্রুপিং আছে। এ কারণে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি খুবই অপমানিত বোধ করছি।’
জানা গেছে, পটিয়ায় পিটিআইতে দেড় বছরের কোর্সে প্রতি ব্যাচে ২০০ জন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন। প্রশিক্ষণের পুরো সময় ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
এদিকে দেবব্রত বড়ুয়ার অভিযোগকে সমর্থন করে শনিবার বিকেলে ক্লাস ছেড়ে ক্যাম্পাসে আসেন প্রশিক্ষণার্থীরা। খবর পেয়ে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বোরহান উদ্দিন সেখানে যান।
ইউএনও ফারহানা জাহান উপমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘৩০-৪০ জনের মতো শিক্ষার্থী মানববন্ধনে এসেছিলেন। তাদের অধিকাংশই মেয়ে। তারা বলেছেন, দেবব্রত বড়ুয়া যা বলেছেন সেটা সত্যি। তারা ক্লাসে যৌন হয়রানির শিকার হন। ধর্ষণের কথাও কয়েকজন বলেছেন। সেখানে পরিস্থিতি এমন ছিল, পারসন টু পারসন ডেকে কথা বলতে পারিনি। তাদের বলেছি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ লিখিতভাবে দিতে। তখন তদন্ত করে অবশ্যই প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপ নেব। আর আত্মহত্যার চেষ্টার বিষয়টি পুলিশ দেখবে।’
পিটিআইয়ের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট তপন কুমার দাশ এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
আত্মহত্যাচেষ্টা চট্টগ্রাম পিটিআই পিটিআই পিটিআই প্রশিক্ষক পিটিআই প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ধর্ষণের অভিযোগ সহকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ