যেভাবে রক্ষা পায় ৭ মার্চের ভাষণের ফিল্ম
৭ মার্চ ২০২০ ২১:২০
ঢাকা: যে ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, যে ভাষণে ছিল স্বাধীনতার সুর, যে ভাষণে দেশমাতৃকার স্বাধীনতায় অংশ নিয়েছিল লক্ষ জনতা— সেই ভাষণের রেকর্ড রক্ষা করতেও ধরতে হয়েছিল জীবনবাজি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রাংকে করে রেকর্ড ফিল্মটি ঢাকা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ধানের গোলায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সেটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ভারতে, যা স্বাধীনতার পর পুনরায় দেশে ফিরে আসে।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড সংরক্ষণের গল্পের শুরুতেই তৎকালীন ভাষণ রেকর্ডকারীর সহকারী ক্যামেরাম্যান আমজাদ আলী খন্দকার (৭০) বললেন এসব কথা। শনিবার (৭ মার্চ) রাজধানীর তথ্য ভবন মিলনায়াতনে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর আয়োজিত আলোচনা সভা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা জানান।
অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংরক্ষণের বিষয় জানতে চাইলে আমজাদ আলী খন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ভিডিও ধারনের জন্য সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ৭ মার্চের ভিডিও রেকর্ড ফিল্ম জমা ছিল তৎকালিন ফিল্ম শাখায়, যার পরিচালক ছিলেন আবুল খায়ের মোহাম্মদ মহিব্বুর রহমান। এই ভাষণের গুরুত্ব বুঝে তখনই তিনি আমাকে ভাষণটির ফিল্ম রেকর্ড নিয়ে পালিয়ে যেতে বললেন। ’
তিনি বলেন, ‘একদিন স্যার (আবুল খায়ের) আমাকে বললেন তুমি একটা ট্রাংক কিনে নিয়ে আসো। আমি স্যারের কথামতো সদরঘাট থেকে একটা ট্রাংক কিনে নিয়ে এলাম। এরপর ভাষণের ফিল্মসহ ডকুমেন্ট ট্রাংকে ভরে আমাকে বললেন এটা নিয়ে পালিয়ে যাও। তখন আমি স্যারকে বললাম, আমি বাবার কাছে বলে আসি। সঙ্গে সঙ্গে বাবার কাছে গিয়ে বললাম, বাবা আমি ঢাকার বাইরে যাব, তুমি কোনো চিন্তা করোনা। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি অফিসে চলে আসি। তখন স্যার আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে ট্রাংকটি দেখিয়ে আমার হাত ধরে একটা ঝাঁকি দিলেন এবং বললেন আল্লাহ ভরসা। তখন আমাদের অফিস ছিল সচিবালয়ে। সচিবালয়ের গেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল পাঞ্জাবিরা। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে বের হবো তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম।’
‘সে সময় গেটে একজন মাত্র বাঙালির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তখন পল্টনের দিকে একটা গেট ছিল। সেইখান দিয়ে শুধু প্রবেশ করা যেত, তার সহযোগিতায় ওই গেট দিয়ে উল্টোদিকে একটি বেবিটেক্সি করে ট্রাংকটি নিয়ে বের হয়ে যাই। সে সময় অন্যকোনো চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আমার একটাই চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রক্ষা করতে হবে’, বলেন এই সাহসী যোদ্ধা।
এরপর আমি ট্রাংকটি নিয়ে চলে যাই সোয়ারিঘাটে, সেখান থেকে নদী পাড় হয়ে জিনজিরা গিয়ে বাসে উঠি জানিয়ে আমজাদ আলী বলেন, ‘ট্রাংকটি বাসের ছাদে করে নিয়ে যাওয়ার সময় অনেক ভয় কাজ করেছে। যদি পাকিস্তানিরা দেখে ফেলে বা চেক করে। তাহলে তো সবই যাবে। তারপরও আল্লাহর ভরসা করে দোহার চলে গেলাম। দোহার গিয়ে বাস থেকে নেমে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার ঘোড়া ও মাথায় করে ট্রাংক নিয়ে জয়পাড়া গ্রামে আবুল খায়ের স্যারের বোনের বাড়িতে উঠি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে দোহার থানায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্প করা হয়। পরে সেখান থেকে চরকুশাইরহাট গ্রামে খায়ের স্যারের ভাগ্নির বাড়িতে নিয়ে যাই ট্রাংকটি। সেখানে তাদের বিশাল ধানের গোলার মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয় সেটি। কিছুদিন যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা এসে সেখান থেকে ট্রাংকটি ভারতে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে সেটি ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে, এভাবেই লুকিয়ে রেখে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে আমরা রক্ষা করি।’ জীবনবাজি রেখে পাকি আর্মিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যে ভাষণ তিনি রক্ষা করতে পেরেছিলেন এটিই তার গর্বের বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার বাসিন্দা আমজাদ আলী ১৯৬৫ সালে দুই বেলা খাবার ও তিন টাকা রোজে এফডিসিতে ক্যামেরার সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর সেখানে কয়েক বছর কাজ করার পর ১৯৬৯ সালে তৎকালীন ফিল্ম শাখায় সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ২০০৪ সালে তিনি অবসরে গিয়েছেন। ১৯৮২ সালে ফিল্ম শাখা থেকে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর নাম পরিবর্তন হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ধারণকারী ক্যামেরাম্যান, সহকারী ক্যামেরাম্যানসহ ৮ জনকে সম্মাননা স্মারক দেয় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর। সেই আট জনের মধ্যে এখন আমজাদ আলী খন্দকার ও সৈয়দ মইনুল আহসান জীবিত আছেন।