পুরুষের ভাবনায় নারী দিবস
৮ মার্চ ২০২০ ১০:০৯
ঢাকা: দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগের কথা। সময়টা ১৮৫৭ সাল। মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নামলেন সূতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। এরপর প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চললো আন্দোলন আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। ১৯১১ সাল থেকে একটি দিন নারীদের সম-অধিকারের দিবস হিসেবে পালিত হলো। শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়। পরে ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে এসে ৮ মার্চের দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
জাতিসংঘের স্বীকৃতির প্রায় ৫০ বছর হতে চললেও অনেক দেশেই একশ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় আগে থেকেই পালিত হচ্ছে নারী দিবস। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য— ‘প্রজন্ম হোক সমতার/সকল নারীর অধিকার।’ নারী দিবস নিয়ে কী ভাবছেন আজকের পুরুষ? কথা হলো বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে।
নারী দিবস বিষয়ে ভাবনা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক বললেন, আন্তর্জাতিক এইসব দিবস আসলে অনেকটাই পোশাকি। একটি দিন কিছু আনুষ্ঠানিকতা, সভা আর বক্তব্য দিয়েই সেরে ফেলা হয় দায়িত্ব, যা তেমন কার্যকর নয়। যে ভাবনা নিয়ে এই নারী দিবস উদযাপন শুরু হয়েছিল, তা আর নেই। কারণ একদিনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরদিন থেকে আর কিছু হয় না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, নারীকে ঘরে আটকে রাখা ঠিক নয়। মেয়েদের আরও বেশি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এভাবেই তারা অচলায়তন ভাঙতে এগিয়ে আসতে পারবে।
বাংলাদেশের নারীরা প্রতবেশী দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা এগিয়েছে বলে মনে করেন এই কথাসাহিত্যিক। দেশের মেয়েদের চলার পথে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বাধা হয়ে দাড়ালেও নারীরা দমে না গিয়ে স্বমহিমায় এগিয়ে গিয়েছেন বলেও তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন পুরুষের হাত ধরে হয় না। সেক্ষেত্রে তা পুরুষের শর্তানুযায়ী হয়। ফলে প্রকৃত ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। নারীর নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে নিজের ক্ষমতায়নের জন্য। তারা এগিয়ে আসছেও। দেখা যায়, একজন নারী শিক্ষিত হলে তিনি তার সন্তানের শিক্ষার জন্য ব্যয় করেন। তারাই নিজেদের ও সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি।
বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদের মতে, একদিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, নারী দিবসের তাৎপর্য হওয়া উচিত নারীকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। সেই শিক্ষা হতে হবে বিজ্ঞানমনস্ক, মনকে জাগিয়ে তোলা সৃজনশীল শিক্ষা। তাছাড়া নারীর কর্মসংস্থান ও সামাজিক অবস্থান ঠিক করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে কাজ করা সব অপশক্তিকে প্রতিহত করতে সমাজ ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এক নম্বর অগ্রাধিকার দিতে হবে। আজও দেখা যায় মেয়েরা একা বাসা ভাড়া নিতে পারে না। বাড়িওয়ালারা একা নারী শুনলেই বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। কিন্তু অনেক মেয়েই দেখা যায় একা অথবা সন্তান নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে চান। এটির নিশ্চয়তাও সরকারকেই দিতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে নারীদের একা থাকার সুরক্ষা দিতে হবে।
নারী দিবসের প্রাক্কালে নারীর স্বাধীনতা হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল চান, নারীর শরীরের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তারা যা নিজের জন্য চায় সেটিই যেন পায়, তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। আর লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে সারাবছর নারীর সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের কাজ করতে হবে এবং এক বছর পর সারাবছরের কাজের অগ্রগতির হিসেব নিতে হবে। নারীকে আরও এগিয়ে নিতে সরকারি কাঠামোর মধ্যে নারীর কর্মসংস্থান ও সমান অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একবার এই কাঠামোর মধ্যে ঢুকে গেলে নারীরা নিজেদের মতো করে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক এই দিবসকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান। এর কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা নারীদের যথেষ্ট সম্মান করি না, তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিই না। তবে মাত্র একদিন নয়, নারীদের সারাবছরই সম্মান করা উচিত। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারাবিশ্বেই নারীদের অধিকার বিষয়ে অত উন্নতি হয়নি। আরও অনেক কাজ বাকি আছে। নারী দিবস আমাদের সেইসব অসমাপ্ত কাজ শেষ করার কথা মনে করিয়ে দেয়।
ঢাকা ট্রিবিউন সম্পাদক বলেন, নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা এখন নিত্যকার সংবাদ। বেশ কয়েক বছর হলো আন্তর্জাতিক মহলে নারীরা মুখ খুলতে শুরু করেন তাদের প্রতি ঘটে যাওয়া অত্যাচার বিষয়ে। #মিটু নামের সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে এই বদ্বীপেও। কিন্তু বেশি আলোড়ন তোলার আগেই থমকে যায় সেই আন্দোলন।
জাফর সোবহান মনে করেন, #মিটু সবাইকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। বাংলাদেশে সামাজিক, পারিবারিক নানাভাবে নারীরা অত্যাচারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন। তাছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতার সব সংবাদ রেকর্ডেড হয় না। তারপরও সংখ্যাটা উদ্বেগজনক।
এর মূল কারণ হিসেবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা বলেন জাফর সোবহান। তিনি বলেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। যারা নারী ও শিশু নির্যাতন করছে, তারা ধরা পড়লেও কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পান অথবা কঠোর বিচারের মুখোমুখি হন না। এতে তাদের মধ্যে যা ইচ্ছা তাই করার মনোভাব তৈরি হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।
নারী দিবস যেভাবে পালিত হয়, তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এই দিবসটি নারীর ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার, নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণকে স্মরণ করিয়ে দেয় বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, নারীর ওপর বহুকাল ধরেই শোষণ চলছে, যা এখনো অব্যাহত। মালিকরা যেভাবে শ্রমিকের ওপর শোষণ করে, নারীর ওপরও একইরকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চলছে। এর কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এই সমাজে দুর্বলকে শোষণই সম্পদ তৈরির উপায়।
সেলিম বলেন, নারী যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পুরুষের ওপর নির্ভরশীল, তাই তাদের ওপর অত্যাচার করা সহজ। আর নারীকে অর্থনৈতিকভাবে তো বটেই, পিছিয়ে রাখা হয়েছে সামাজিকভাবেও।
বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ মনে করেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীকে পূর্ণ স্বাধীনতা এনে দেবে। তবে তা রাতারাতি হবে না। হাজার হাজার বছর ধরে নারীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ঘটে চলছে। একদিনে দূর হবে না, সময় লাগবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হলো নারীর মুক্তির সূচনাবিন্দু।
ইংরেজি ফ্যাশনের কোনো পছন্দ করেন না নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি বলেন, পশ্চিমা সমাজে মা-বাবা পর্যন্ত পরিবারের অংশ নয়। শুধুই স্বামী-স্ত্রী মিলে পরিবার। তাই তাদের বিভিন্ন দিবস প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হাজার বছর ধরেই সবাই মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতি। তাই আমাদের কোনো দিবসের প্রয়োজন থাকা উচিত না। কারণ দেখা যায়, এসব দিবসে একদিনই উদযাপন করা হয় ও সারাবছর ভুলে থাকা হয়।
নারীকে ঘরে ও বাইরে সারাবছরই সম্মান দিতে হবে উল্লেখ করে হাসান ইমান বলেন, সবাই মিলে নারীর সমাধিকারের জন্য কাজ করতে হবে। একদিন নারীর অধিকার নিয়ে বক্তব্য দিয়ে পরদিন থেকে বউ পেটালে চলবে না। পরিবার থেকেই নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
দিবসের আয়োজনকে পুঁজিবাদী বিশ্বের ব্যবসার ধান্ধা আখ্যায়িত করে এই নাট্যব্যক্তিত্ব বলেন, এর মাধ্যমে তারা নারীক নিয়ে ব্যবসা করে, যা আসলে নারীর অধিকার ও সম্মান রক্ষায় খুব একটা কাজে লাগে না। যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখে ও দেখায়, তারাই দেখা যায় বড় করে একটি দিন নারী দিবস হিসেবে পালন করছে। কিন্তু এ দেশে সবসময় নারীকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আজ নারী নির্যাতন বেড়েছে।
‘তাই একদিনের জন্য নারী দিবসের আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রয়োজন সারাবছর নারীকে সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা,’— মন্তব্য সৈয়দ হাসান ইমামের।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারী দিবস নারী-পুরুষ সমতা নারীর ক্ষমতায়ন নারীর প্রতি বৈষম্য