উচ্ছ্বাস উন্মাদনায় শেষ হলো জয় বাংলা কনসার্ট
৮ মার্চ ২০২০ ০১:৪৬
ঢাকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির ডাক। সেদিনের সেই অবিনাশী কণ্ঠস্বরে উজ্জীবিত হয়েই বাংলাদেশ পেয়েছিল তার পরম আরাধ্য স্বাধীনতা। আর ওই ভাষণের সূত্র ধরে শনিবার আবারও ইতিহাসকে আলিঙ্গন করলো বর্তমান। জয় বাংলা কনসার্টে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানে ফিরে এলো একাত্তরের শৃঙ্খল ভাঙা ঐক্যের চেতনা।
শনিবার (৭ মার্চ) দুপুরে জয় বাংলা কনসার্টের শুরু হয় জয় বাংলা স্লোগানের মাধ্যমে। এরপর গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। এসময় আর্মি স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজারো তরুণ-তরুণী বুকে হাত রেখে গেয়ে উঠেন আমার সোনার বাংলা। এরপর বাজানো হয় আওয়ামী লীগের প্রচার সঙ্গীত ‘জয় বাংলা বলে আগে বাড়ো’ গানটি। গানটির মাধ্যমে শোনানো হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একাংশ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এরপর মারিয়া নূরের সঞ্চালনায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি ব্যান্ড পারফর্ম করে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানের পাশাপাশি এই প্রজন্মের জনপ্রিয় ব্যান্ড দলের নিজস্ব পরিবেশনাও ছিল কনসার্টে। আর সবটাই হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে উপজীব্য করে। তাই তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে-উন্মাদনায় কনসার্টও চলল দুপুর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত।
এবারের কনসার্টে দারুণ সাড়া ফেলেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী শিল্পীদের ব্যান্ড দল এফ মাইনার। ‘নোঙ্গর তোলো তোলো/সময় যে হলো হলো’ গানটি দিয়ে শুরু হয় তাদের পরিবেশনা। এরপর তারা শুনিয়েছে ‘সমস্ত রাত আগলে রাখি বাড়ি/সমস্ত দিন নিজের সঙ্গে আড়ি’। দলটির গাওয়া ‘হেথায় তোকে মানাইছে নারে/তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা’ শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছে গানপ্রেমীরা। এছাড়াও ত্রিপুরা ভাষার একটি গানও শুনিয়েছে তারা।
স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী সুজেয় শ্যামের সুরে মিনার গেয়েছেন ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’। এরপর শুনিয়েছে ‘তুমি চাইলে বৃষ্টি দেবো’, ‘যে ছিল মনের অচিনপুরে’সহ কিছু গান।
এ্যাভোয়েড রাফা শুনিয়েছে ‘চলো আরেকবার উড়ি’সহ কয়েকটি গান। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল’সহ কয়েকটি গান পরিবেশন করে ভাইকিংস।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ শিরোনামের সঙ্গীত দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে ব্যান্ড দল শূন্য। এরপর দলটি গেয়েছে ‘চলো আজ ফিরে যাই গোধূলির ওপারে’, ‘শত আশা’, ‘চাইলে তুমি হারিয়ে যাও’সহ কয়েকটি গান।
‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে ব্যান্ড দল লালন। এরপর দলটি একে পরিবেশন করে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘ক্ষ্যাপারে’, ‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’সহ কয়েকটি গান।
সন্ধ্যার আগে মঞ্চে ওঠে ব্যান্ড লালন ও আরবোভাইরাস সদস্যরা। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পুরো ক্লিপটি শোনানো হয়। এসময় কয়েক মুহূর্তের জন্য স্টেডিয়ামের ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতারা ফিরে যান ১৯৭১ সালের আবহে। গোটা স্টেডিয়াম নিস্তব্ধ হয়ে শ্রদ্ধা জানায় জাতির পিতাকে।
এরপর পর মঞ্চ মাতাতে আসে ক্রিপটিক ফেইট, নেমেসিস। দেশ সেরা এসব ব্যান্ডের প্রতিটি সদস্যের পরিবেশনা মুগ্ধ হয়ে শোনেন শ্রোতারা।
সবশেষে চিরকুট, ফুয়াদ এন্ড ফ্রেন্ডস শেষদিকে শ্রোতাদের মাঝে ছড়িয়েছেন তুমুল উন্মাদনা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি স্বল্প পরিচিত ব্যান্ড দলও আকর্ষণ বাড়িয়েছে পুরো আয়োজনটির। সেই সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রাফিকাল রিপ্রেজেন্টেশন শ্রোতাদের দিয়েছে উত্তাল সেই দিনগুলোর অনুভূতি। ফলে প্রায় দশ ঘণ্টার এ আয়োজনটি ক্রমাগত দোল খেয়েছে ইতিহাস আর বর্তমানে।
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) ও ইয়াং বাংলার তত্ত্বাবধানে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জয় বাংলা কনসার্ট।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এবার কনসার্টে কিছু ভিন্নতা ছিল। এদিন কনসার্ট চলার মধ্যেই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে স্টেডিয়ামে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
ছয় বছর ধরে ঐতিহাসিক সাতই মার্চে জয়বাংলা কনসার্ট হলেও এবারই প্রথম সেখানে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছিলেন শেখ হাসিনা। তখন তিনি নিজেই তরুণ। দেশকে স্বাধীন করার উন্মাদনা তখন তার ভেতরে বাহিরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশের বিবিধ উত্থান-পতনে তরুণদের ভেতর এমন জোয়ার তিনি দেখেছেন। যার শেষটি তিনি আজ দেখলেন জয় বাংলা কনসার্টে।
পশ্চিম পাশের গ্যালারিতে বোন শেখ রেহানা ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে পাশে বসিয়ে তিনি মন দিয়ে শুনেছেন একাত্তরের উত্তাল সময়ে পথ দেখানো সেইসব গান। আর গানের তালে উন্মাতাল হওয়া তরুণদের দেখে হয়েছেন মুগ্ধ। কয়েকবার হাততালি উৎসাহিতও করেছেন তাদের। কোনো কোনো গানে উৎসবের উৎসাহে মিশিয়ে দিয়েছেন নিজের গানের স্বর।
শেখ হাসিনা যেখানে বসেন, সেই পশ্চিম পাশের গ্যালারিটি সাজানো হয় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ও উদ্ধৃতি দিয়ে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে ছিল কয়েকটি রেপ্লিকাও। সেখানে শেখ হাসিনার পাশেই বসেছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। হাসিনাকন্যা সায়মা ওয়াজেদ ছাড়াও মুজিব দৌহিত্র ও সিআরআইয়ের ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও ছিলেন গ্যালারিতে।
পশ্চিম পাশের গ্যালারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মন দিয়ে শোনেন তাদের গান। এরপর দশটার দিকে কনসার্ট থেকে বিদায় নিয়ে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা।
এবারের আয়োজনের আরেকটি বড় চমক ছিলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হলোগ্রাফিক রিপ্রেজেন্টেশন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ২৩টি বাক্য বাছাই করে নির্মিত হয় এই প্রজেকশন।
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি নসরুল হামিদ বিপু বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যেনো তরুণরা বুঝতে পারে এজন্যই এ আয়োজন। সে দিনটি কেমন ছিল সেটি হয়তো পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়, তবে এমন লোক সমাগমের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে আমরা সেই অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। বঙ্গবন্ধুকে জানতে না পারলে বাংলাদেশকে জানা সম্ভব নয়। তাই মহান নেতাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে এমন আয়োজন নিয়মিত উপহার দেওয়া হবে।
তিনি জানান, এই কনসার্ট টেলিভিশন ও অনলাইনে তিরিশ লাখেরও বেশি মানুষ উপভোগ করেছেন। আর স্টেডিয়ামে উপস্থিত থেকে কনসার্ট উপভোগ করেছেন পঞ্চাশ হাজার মানুষ।
জয় বাংলা কনসার্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নসরুল হামিদ বিপু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক শেখ হাসিনা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল