সংকট নেই স্যানিটাইজারের, বাড়তি দামে না কেনার পরামর্শ
১০ মার্চ ২০২০ ০০:৫৪
ঢাকা: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পরার পরই দেশে বেড়েছিল মাস্কের দাম। দেশে করোনায় আক্রান্ত তিনজন রোগীর সন্ধান পাওয়ার পর এক রাতের ব্যবধানেই লাফিয়ে বেড়েছে এই পণ্যের দাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যটির দাম বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ। একই সঙ্গে বিভিন্ন বাজার, ফার্মেসি ও সুপারশপগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের। এসব পণ্যের বাড়তি দাম রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে ওষুধ শিল্প সমিতি ও স্যানিটাইজার সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তাদের কাছে স্যানিটাইজার সামগ্রীর পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বাড়তি দামে এসব পণ্য না কেনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। করোনায় আক্রান্ত কিংবা তাদের সংস্পর্শে না যাওয়া ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে মাস্ক ব্যবহার না করারও পরামর্শ তাদের।
এদিকে বাড়তি দামে বাজারে মাস্ক বিক্রি বন্ধে ভ্রামম্যাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও অভিযান পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে তারা অভিযান চালিয়ে বেশি দাম নেওয়ার অভিযোগে আল নূর ফার্মেসি ও সাফাবি ফার্মেসিকে সিলগালা করে দিয়েছে।
ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডওয়াশসহ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা থাকার চিকিৎসা সামগ্রীর পর্যাপ্ত মজুদ সবার কাছে রয়েছে। এটি নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। দেশে করোনভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী সনাক্ত হওয়ার পর ফার্মেসি ও দোকানগুলোতে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সংকট দেখা দেয়। তার আগে সবই ঠিকঠাক ছিল। সরবরাহ পরিস্থিতি আবারও ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’
তিনি জানান, দেশে আরএফএল, বসুন্ধরা ও গেট ওয়েল সার্জিক্যাল মাস্ক উৎপাদন করে থাকে। বাজারে সার্জিক্যাল মাস্কও রয়েছে। মাস্ক যাতে বেশি দামে কেউ বিক্রি করতে না পারে সেজন্য ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার জাতীয় পণ্যের দাম আগের মতোই রয়েছে। কেউ যেন বেশি দামে তা না কেনেন। করোনাভাইরাস আক্রান্ত ছাড়া কারও মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই বলেও উল্লেখ করেন ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড’র ডিরেক্টর (হেড অব অপারেশন) মালিক মো. সাঈদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডওয়াশের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। গত এক মাস ধরে আমরা বাজারে সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে রেখেছি। কোনো জায়গায় বেশি সাপ্লাই করছি না, যাতে বাজারে কেউ মজুদ করতে না পারে। আর আমরা প্যানিকের সঙ্গেও তাল মিলিয়ে চলতে চাই না।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে যা কিছু করণীয়
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি মাসে আমাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ পিস। পূর্বে উৎপাদনও এমন ছিল। কিন্তু গত এক মাস ধরে আমরা উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছি। বাইরে রফতানি করার জন্য আমাদের অর্ডার ছিল। আমরা তা ক্যান্সেল করেছি। একমাত্র সরকারি কোনো নির্দেশনা ছাড়া এখন আমাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার জাতীয় কোনো পণ্য বাইরে রফতানি হবে না। ’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘দেশের ১৭ কোটি মানুষ যদি একসঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে শুরু করে তবে হয়তো আমরা সাপ্লাই দিতে পারবো না। তবে নিয়মিত যে চাহিদা তা পূরণ করা সম্ভব। সেই চাহিদার চেয়ে কিছু বাড়তি চাহিদাও পূরণ করতে আমরা প্রস্তুত।’
এসিআই কনজুম্যার ব্রান্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) সৈয়দ আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়, বিশেষত করোনাভাইরাসের সময়ও যা ব্যবহৃত হচ্ছে, আমাদের কাছে তার যথেষ্ট মজুদ রয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত বলা যাবে না। হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় দোকানগুলোতে হয়তো হ্যান্ড স্যানিটাইজার নেই। কিন্তু কিছু কিছু দোকানে এখনও রয়ে গেছে। আমরা অন্যান্য সময় যেভাবে সাপ্লাই দিয়েছি, এখনও সেভাবে সরবরাহ করে যাবো। গায়ের দামেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি হবে। দাম বাড়ার সুযোগ নেই। আমরা ক্রেতাদের বাড়তি দামে এসব পণ্য না কেনার অনুরোধ করবো।’
করোনাভাইরাসে শঙ্কার কারণ নেই, আক্রান্ত তিনজনের অবস্থা ভালো
এদিকে সোমবার (৯ মার্চ) বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফার্মেসিতেই মাস্ক নেই। তবে দু’একটি দোকানে সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হচ্ছিল। তেমনই একটি ফার্মেসি সুনান ফার্মা। ফার্মগেটের এই দোকানটিতে সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হচ্ছিল ৫০ টাকা পিসে, পূর্বে যে মাস্কের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ফার্মেসির এক কর্মচারী বলেন, ‘মিটফোর্টে আজ প্রতি বক্স সার্জিক্যাল মাস্কের দাম হাঁকা হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। অথচ এই এক বক্সের দামই ছিল মাত্র ৩৬ টাকা। আগে আমরা ৫০ টাকা বক্সে বিক্রি করতাম।’
ওই দোকান থেকে দু’টি সার্জিক্যাল মাস্ক কিনেছেন সাভারের বাসিন্দা সানজিদ সারোয়ার। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আধা ঘণ্টা ধরে অন্তত ১০টি দোকানে খুজে ফার্মগেটের এই দোকানটিতে সার্জিক্যাল মাস্ক পেয়েছি। ২টির দাম রেখেছে ১০০ টাকা। অথচ অন্য সময় এ দুটির দাম ছিল ১০ টাকা। টাকা বেশি নিলে তো আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা জিম্মি হয়ে গেছি। দাম বেশি থাকায় চাহিদার চেয়ে কম মাস্ক কিনতে হচ্ছে।’
এদিকে, ফুটপাতের বিভিন্ন দোকানে ২০ থেকে ১৫০ টাকায় বিভিন্ন প্রকারের দেশি মাস্ক বিক্রি করতে দেখা গেছে। ফার্মগেটের ফুটপাতে কথা হয় দোকানি সাইফ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ফিল্টারযুক্ত বাংলা মাস্ক ১৫০ টাকা ও ফিল্টার ছাড়া মাস্ক ১০০ টাকায় বিক্রি করছি। সকালে গুলিস্তান ও বঙ্গবাজারের পাইকারি বাজারে ফিল্টার ছাড়া বাংলা মাস্ক ১২ পিস ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ দুপুরে সেই মাস্ক আমাদেরই কিনতে হচ্ছে ১২০০ টাকায়।’
এই বিক্রেতা জানালেন, ফিল্টারসহ যে মাস্ক ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গতকাল সেই মাস্কের দাম ছিল ৪০ টাকা। এদিকে, গেঞ্জির পাতলা কাপড় দিয়ে তৈরি মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। গতকাল রাতেও এই মাস্ক বিক্রি হয়েছে ১০ টাকা করে।
একাধিক ফার্মেসি ও কয়েকটি সুপারশপ ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানেই হেক্সিসল, স্যানিটাইজার, ক্লিন জেল ও স্যাভলনের সংকট রয়েছে। তারা জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলো অর্ডার নিচ্ছে না। অর্ডার নিলেও কখন সাপ্লাই দিবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে বড় বড় কিছু ফার্মেসিতেও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রীর বাড়তি দাম রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
লাজ ফার্মার রামপুরা শাখায় ১০ মিলিলিটারের ক্লিন জেলের দাম রাখা হয়েছে ১২০ টাকা, যদিও পণ্যটির গায়ের দাম ৭৫ টাকা। তবে ক্লিন জেল বিক্রির রশিদটিও দেওয়া হয়েছে সাধারণ কাগজে।
শাহীনবাগের নাছের ফার্মার সত্ত্বাধিকারী লিটন সারাবাংলাকে বলেন, ‘হেক্সিসল ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রী গতকাল রাতেই শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে অর্ডার দিয়েও দুপুর পর্যন্ত এসব সামগ্রী পাওয়া যায়নি। অন্যান্য একাধিক ফার্মেসির মালিকও একই তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে সুপার শপ স্বপ্ন ও আগোরাতেও মিলছে না স্যাভলনসহ হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রী। সেগুনবাগিচার আগোরার বিক্রয়কর্মী সোয়েব বলেন, ‘স্যাভলন বাদে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কোনো পণ্য আমাদের এখানে নেই। সকালেই শেষ হয়ে গেছে।’ অন্যান্য দিনের চেয়ে সাবান, স্যাভলন, টিস্যু পেপার আজ বেশি বিক্রি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
করোনাভাইরাস না কেনার পরামর্শ বেড়েছে দাম স্যানিটাইজার হেক্সিসল হ্যান্ডরাব