Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিল্প-বাণিজ্য থেকে শিল্প-সংস্কৃতি


৯ মার্চ ২০২০ ২২:৪৫

রোববার চেন্নাই এয়ারপোর্টের কাছে আমাদের হোটেল থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, তখন বাসে ওঠার আগে কথা বলছিলেন আমাদের দেখভালের জন্য নিয়োজিত ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ। বলছিলেন এখন যেটি দেখবেন, এটি আরেক ভারত। ভারতের প্রাইভেট সেক্টর কোন জায়গায় পৌঁছেছে তার কিছুটা ধারণা পাবেন। আমি তখনো এতটা বিস্মিত হব ভাবিনি।

আরও পড়ুন: চোখের মন্দির

দুপুরের খাবারের পর কড়া রোদের ভেতরেই বাস যখন কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিল, বুঝতে পারছিলাম, এটি এ কয়দিনের চেনা চেন্নাই নয়। দু’পাশে সবুজ বনভূমি রেখে অতি পরিচ্ছন্ন সড়কপথে আমাদের বাস এগিয়ে এসে যেখানে থামল, সেটি এক নতুন তামিল নাড়ু যার নাম মাহিন্দ্র ওয়ার্লড সিটি। বিশ্ব নগরী, কারণ এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬০টিরও বেশি বহুজাতিক কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে।

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে প্রথম ইন্টিগ্রেটেড ব্যবসা শহর এবং কর্পোরেট ভারতের প্রথম কর্মক্ষম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ১ হাজার ৫৫০ একর ক্যাম্পাসে তথ্য-প্রযুক্তি থেকে শুরু করে রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুতকারী, আবাসন খাত থেকে তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানি, কিংবা বিএমডব্লিউ গাড়ি- সব বড় প্রতিষ্ঠানই আছে এখানে।

এই বিশ্ব নগরীর ব্যবস্থাপক বিপিন ড্যানিয়েল জানালেন, এই শিল্পপার্কে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০ হাজার লোকের। তবে এর বাইরে আরও ৬০ হাজার মানুষ নানাভাবে এখানকার বিভিন্ন কাজে জড়িত। শিল্প নগরী কিন্তু সবুজে ঘেরা, এমনটা কি করে সম্ভব হল? বিপিন বলেন, শুরু থেকেই চেষ্টা ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি না করে শিল্প-বানিজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই শহর করতে গিয়ে কোনো গ্রামবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়নি। তারা আছেন তাদের বাড়িতে তাদের জীবন ধারা বজায় রেখে, আর তাদের ঘিরেই গড়ে উঠেছে ঝা চকচকে সব বড় বড় প্রতিষ্ঠান। যেখানে আবার কর্মসংস্থানও হয়েছে তাদের। এখান ঢুকতে বা বের হতে কাউকে বাধাও দেওয়া হয় না। কিন্তু তাই বলে নিরাপত্তা ব্যবস্থখায় কোনো ঘাটতি আছে, তাও বলা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

এই শিল্প নগরী বন্যা প্রতিরোধক, যদিও প্রাথমিক অবস্থায় তা ছিল না। নিজস্বতায় পরিপূর্ণ এই শহরে রাসায়নিক ছাড়া সব বর্জ্যই পরিশোধিত হয়। খাদ্য বর্জ্য পরিশোধিত হয়ে গ্যাস উৎপাদিত হয়, যা দিয়ে প্রায় সব গাড়ি চলাচল করে এবং এ জ্বালানি বিনামূল্যে শহরের ভেতরের বাসিন্দাদের দেওয়া হয়।

বিপিন বলেন, সবাই মাহিন্দ্রকে জানে যে, এটি গাড়ি তৈরির বড় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মাহিন্দ্র সেই পরিচয়ের বাইরে নিজেকে নিয়ে গেছে শিল্প সহায়কের স্তরে। এই শিল্প পার্কের চেয়েও বড় আরেক শিল্প পার্ক তারা করছে আরেক রাজ্যে এবং এ জন্য তাদের নতুন প্রতিষ্ঠান মাহিন্দ্র লাইফস্পেস। শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান যেমন আসছে, তেমনি এই শহরের ভেতরই গড়ে উঠছে পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা। ৪ কোটি রুপির ভিলা থেকে ১০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল নিয়ে এক স্বপ্নভূবন।

বিপিনের মতে, ছোট করে ভাববার দিন শেষ। শিল্প আর বাণিজ্য নিয়ে বড় মাপের প্রকল্প জরুরি, যা বাকিদের ভরসা জোগায়। তার মতে শিল্পের প্রথম সমস্যা জমি। সরকার জমি-ব্যাঙ্কের কথা বললেও, সেখানে এক লহমায় বড় জমি তেমন মেলে না। অবকাঠামোও যথেষ্ট নয়। সঙ্গে দোসর, শহরে জমির ঊর্ধ্বসীমা আর আইনের মারপ্যাচ। এই বিশ্ব নগরীর ক্লাবে বসেই জানা গেল এইসব সমস্যাকে মোকাবিলা করে এগিয়ে চলেছে মাহিন্দ্র শিল্পের নতুন ঠিকানা গড়তে। যেখানে বাংলাদেশের এক বিনিয়োগকারীও জায়গা পেয়েছেন। হ্যাঙ্গার প্লাস নামের সেই কোম্পানির কাউকে অবশ্য এই ছুটির দিনে পাওয়া গেল না।

এই সুপার সিটির সুপার লাইফের কথা মাথায় থাকতে থাকতেই আজ সকালে গেলাম আরেক বিস্ময়ে। শিল্প বাণিজ্য থেকে শিল্প সংস্কৃতি। কালাশক্ষেত্র, বাংলায় বললে বোঝা যায় ‘কলা কেন্দ্র’।

বিজ্ঞাপন

প্রতিষ্ঠাতা রুকমিনি দেবি তার জীবনের অভিজ্ঞতায় নৃত্যসহ শিল্পকলার নানাস্তরে বিচরণের এক পর্যায়ে তার মনে হয়েছে, বিষয়টি শুধু শিল্প আর সংস্কৃতির নয়, সমাজে স্বশিক্ষিত, সুশিক্ষিক ভালো মানুষের বড় প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিচালক রেভতি রামাচন্দ্রন বললেন, এই হৃদয়বান মানুষটি তার জীবনের সবকিছু উজাড় করে এই কলাকেন্দ্র সৃষ্টি করেছেন যা আজ সর্বভারতের সবচেয়ে বড় শিল্প-সংস্কৃতি শেখার প্রতিষ্ঠান। ভারত নাট্যমসহ নৃত্যের নানা বিষয়, ভিজুয়্যাল আর্ট-এর ওপর চার বছরের ডিপ্লোমা প্রদানকারী এই কেন্দ্র এখন সরকারের সহযোগিয়তায় উন্নীত হয়েছে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে।

অনেকটা রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের মতো প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠা কলা কেন্দ্রের শিল্পীদের পারফরমেন্স দেখে দেখে ফিরে আসার সময় পরিচালকের কথাটি মনে পড়ল। ব্রিফিং-এর একদম শুরুতে তিনি বলেছিলেন, একটা জাতির ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রশাসন কিছুই এগোয় না যদি শিল্প, সংস্কৃতি আর সাহিত্যকে জীবনের মূল স্রোতে শামিল করার বিষয়টিকে অবজ্ঞা করা হয়।

চেন্নাই বাণিজ্য শিল্প সংস্কৃতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর