বোরোর আবাদ কমছে!
১১ মার্চ ২০২০ ০৮:০৩
ঢাকা: ধানের দাম না পাওয়ায় চলতি মৌসুমে দেশে বোরো আবাদের পরিমাণ কমে গেছে। রোপণ কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে থাকলেও এখন পর্যন্ত বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। আর কৃষকরা বলছেন, ধানের ক্ষেত্রে বোরো আবাদেই সবেচেয়ে বেশি খরচ হয়ে থাকে। দাম না পাওয়া ও শ্রমিকের অপ্রতুলতার কারণেই বোরো চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাভ বেশি হওয়ায় তারা ঝুঁকছেন বিকল্প ফসলে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, হাওরবেষ্টিত সাত জেলায় অন্য এলাকার চেয়ে আগে বোরো চাষ হয়। মূলত এক ফসলি হওয়ায় সেখানে ধানের উৎপাদনও হয় সবচেয়ে বেশি। এবার হাওরের সাত জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে হাওরের ১০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। হাওরের এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। অধিদফতরের তথ্য বলছে, এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা সারাদেশে নির্ধারণ করা হয় ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর। এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৪৩ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদে অগ্রগতির হার ৯০ শতাংশ।
এদিকে, এ বছরে ২ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বীজতলা করা হয়েছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে। বীজতলা তৈরিতে অগ্রগতির হার ছিল ১১৫ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ কম হয়েছে।
সার্বিক দিক বিবেচনায় কৃষি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বোরোর আবাদ কমিয়ে অন্য ফসলের দিকে ধাবিত হচ্ছেন কৃষকেরা। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কৃষক এখন আলু, শাকসবজি, ভুট্টা ও সূর্যমূখী চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যও তা বলছে।
প্রতিষ্ঠানটির সরেজমিন উংয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি রবি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছু কিছু ফসলের আবাদ বেশি হয়েছে। এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে, রোপণ হয়েছে ৪ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। শাক-সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এখানেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে।
এদিকে, ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে। ভুট্টা আবাদে অগ্রগতির হার প্রায় ৯৯ শতাংশ। অন্য বছর ভুট্টার আবাদ আরও কম হয়ে থাকে। একইভাবে সূর্যমূখী আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে। এক্ষেত্রেও অগ্রগতির হার ৯৮ শতাংশ। আগের বছরগুলোতে সূর্যমুখী আবাদের পরিমাণ আরও অনেক কম ছিল।
বোরোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ চন্ডী দাস কুন্ডু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বোরো রোপণ শেষ হয়নি। দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে এখনও রোপণের কাজ চলছে। আরও ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত রোপণ হতে পারে। তবে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে আমরা ধারণা করছি। কারণ কৃষক অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।’
কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান অবশ্য বলছেন, তারা বোরোর আবাদ কমাতেই চান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বোরো আবাদ কিছুটা কমাতে চাই। আউশ ও আমনের আবাদ বাড়াতে চাই। আবাদের পরিমাণ কমলেও চালের উৎপাদন কম হবে না।’
ধান ও চাল উৎপাদনের কিছু তথ্য তুলে ধরে সচিব বলেন, ‘এ বছর আমনের উৎপাদন ১ কোটি ৫০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি। আউশ গত বছর ২৯ লাখ টন হয়েছিল, কয়েক বছর আগেও তা ১৭ লাখ টন ছিল। ভবিষ্যতে আউশের উৎপাদন ৫০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া গত বছর ২ কোটি ৩ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছিল। আমরা এখন ১ কোটি ৯৫ লাখ টন থেকে ২ কোটি টন বোরো ফলকেই পর্যাপ্ত বলে মনে করছি।’
এরপরও সচিব আশাবাদী, বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বোরোর আবাদ ৯০ শতাংশ হলেও শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে আমরা আশা করছি। কারণ দক্ষিণাঞ্চলে বোরোর আবাদ একটু দেরিতে হয়, যদিও সেদিকে উৎপাদনও কম হয়।’ তিনি বলেন, ‘দাম না পাওয়ার কারণে বোরো আবাদ কমছে— এটা যেমন সত্য, তেমনি আমরা ভুট্টা ও সূর্যমূখী চাষকে উৎসাহিত করছি— এটাও সত্য। বর্তমানে ভুট্টা ও সূর্যমুখী চাষ অনেকাংশে বেড়ে গেছে। এসব চাষীদের অনেকেই আগে বোরো চাষি ছিলেন।’
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৃষক কতটুকু ধান চাষ করবে, তা জেনে তো সরকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে না। দাম দিতে না পারলে কৃষক কেন ধান চাষ করবে? ধানের দাম পাচ্ছে না, সেখানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বাহুল্য মাত্র। গোড়াতেই ধানের দাম নির্ধারণ করতে হবে। কারণ ২০০৭ সালে যখন ধানের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল, পরের বছর ২০০৮ সালে কিন্তু এক ইঞ্চি জায়গাও পতিত থাকেনি। অর্থাৎ কৃষক ধানের দাম পাবে কি না, তা যদি রোপণের আগেই জানতে পারেন, তবে তারা উপযুক্ত পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করবেন।’
মাঠ পর্যায়ের চিত্র
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক কৃষকই এ বছর বোরো আবাদের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। দেশের উত্তরাঞ্চলে এবার বোরো আবাদের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন। লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা এলাকার কৃষক আব্দুল খালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দাম না পাওয়ায় এবার বোরোর আবাদ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছি। গত বছর ৩০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করলেও এবার ১১ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। বাকি জমিতে ভুট্টা ও তামাক চাষ করেছি।’ এই কৃষকের মতো অনেক কৃষকই একই পন্থা অবলম্বন করেছেন বলে জানা গেছে।
উত্তরাঞ্চলের আরেক জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকরাও এবার বোরো চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। ফসলের কাঙ্ক্ষিত দাম পেতে তারা ভুট্টা, গম, মরিচ, আলু, মিষ্টি কুমড়া চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়গাঁও গ্রামের কৃষক হরিন্দর বর্মন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ হয় ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা। ধান উৎপাদন হয় ৩৫ থেকে ৪০ মন। দাম পাওয়া যায় আনুমানিক ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে দুয়েক হাজার টাকা লোকসান দিতে হয়। এ কারণে এবার বোরো আবাদ কমিয়ে দিয়েছি।’
একই গ্রামের আরেক কৃষক রফিক বলেন, ‘প্রতি বছর ধানে লস হয়। এলাকার অনেকেই এবার ধানের পরিবর্তে ভুট্টা, গম, মরিচ, আলু চাষ করছে। প্রতিবছর অনেক জমিতে বোরো ধানের চাষ করি। কিন্তু এবার শুধু নিজের খাওয়ার জন্য ধানের আবাদ করেছি।’
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামেও কমেছে বোরো আবাদ। ওই অঞ্চলের মাইজবাড়ী গ্রামের কৃষক রহিম বলেন, ধানের মূল ফসল বোরোই এখন চাষ হচ্ছে না। আমরা এখন আউশ ও আমন চাষে নজর দিচ্ছি। ধানের দাম না পাওয়া, সেচ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, শ্রমিকের উচ্চমূল্য ও অপ্রাপ্তিকেই বোরো আবাদ কমার কারণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।