ডাকসু নির্বাচনের ১ বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিশাল ফারাক
১১ মার্চ ২০২০ ১৪:৩৪
ঢাকা: বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে ছাত্রসংসদ থাকলেও ভারত বিভাগের পর পরই বের হয়ে আসে ডাকসুর আসল চেহারা। ’৪৭ পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করাসহ ’৯০-এর গণআন্দোলনেও ডাকসুর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ’৯০-এর ছাত্রসংসদের পর থেকে মূলত ডাকসুর কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। কারণ নব্বুইয়ের পর থেকে নির্বাচন বন্ধ ছিল। এর জন্য বিভিন্ন সময় আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ভাঙে ২৮ বছরের অচলায়তন। ওইদিন অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষার্থীদের বহুল-কাঙ্ক্ষিত ডাকসু নির্বাচন। সেই হিসাবে আজ ডাকসু নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হলো।
এই এক বছরের ডাকসুর কার্যক্রম কতটুকু হয়েছে; নির্বাচনি ইশতেহারের কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন প্রতিনিধিরা; এক বছরে ডাকসুর সফলতা ও ব্যর্থতা কতটুকু- এসব নিয়ে কথা বলতে চাইলে ডাকসুর সভাপতি (পদাধিকার বলে) ড. মো. আখতারুজ্জামান কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে রাজি হননি। সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর মনে করেন, দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন হওয়াটাই বড় সাফল্য। আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানীর মূল্যায়ন জানতে তাকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি কল ধরেননি। তবে গণরুম সংকট, পরিবহন সমস্যাসহ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে নতুন নির্বাচনের তাগিদ সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) সাদ্দামের কণ্ঠে।
ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসু সদস্য তানভীর হাসান সৈকতের নির্বাচনি ইশতেহারের একটি ছিল আবাসন সংকটের সমাধান। আশ্বাস দিয়েও সংকটের সমাধান করতে না পারার আক্ষেপ থেকে গত বছরের অক্টোবরে নিজেই জসীমউদ্দিন হলের গণরুমে ওঠেন। পরে বিভিন্ন হলের গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানসহ বেশকিছু কর্মসূচিও পালন করেছেন সৈকত। তবে পরিবর্তন আসেনি একটি হলেও।
সৈকতের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রচেষ্টার অভাব ও ডাকসু নেতাদের লেজুরবৃত্তির কারণেই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘এই সমস্যার সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রচেষ্টাই নেই। এছাড়া ডাকসু নেতারা প্রশাসনকে তেল দিতে ব্যস্ত। প্রশাসন যদি তাদের বলে, বসে থাকো, তারা বরং শুয়ে পড়ে; বসেও না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু করার যে উদারতা, তা এই প্রজন্মের নেতাদের মাঝে নেই।’
ডাকসুর কাছে শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবিগুলোর একটি ছিল ক্যাম্পাসের ভেতর যৌক্তিক রিকশা ভাড়া নির্ধারণ। এ নিয়ে সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি দুটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন ছাত্রলীগের প্যানেল থেকেই নির্বাচিত এজিএস, পরিবহন সম্পাদক ও দুই সদস্য। রিকশা ভাড়া নির্ধারণ করা নিয়ে ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান সৈকত ও নজরুল ইসলামের সই করা একটি বিবৃতি প্রকাশ হয় ৭ মার্চ। সেখানে আগামী ১৫ মার্চ থেকে নতুন নির্ধারিত রিকশা ভাড়া কার্যকর হবে বলে জানানো হয়। এর ঠিক দুদিন পরই ৯ মার্চ ভাড়া নির্ধারণ বিষয়ে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন ও ছাত্র পরিবহন সম্পাদক শামস-ঈ নোমানের সই করা পাল্টা একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে ১২ মার্চ মুক্ত আলোচনা আয়োজনের কথা বলেন তারা।
এজিএস ও পরিবহন সম্পাদকের এই বিবৃতিকে ‘ক্রেডিট নেওয়ার ইচ্ছা’ বলে দাবি করেছেন ডাকসু সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। সৈকত বলেন, ‘এর আগে বারবার আশ্বাস দিয়ে তারা শিক্ষার্থীদের ঠকিয়েছেন। একবার ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। আমি সুশৃঙ্খল উপায়ে প্রক্টর, সিটি করপোরেশন, শিক্ষার্থী ও রিকশাওয়ালাদের মতামতের ভিত্তিতে যখন একটি পরিকল্পনা তৈরি করলাম, তখনই তারা পুরো বিষয়টিকে নস্যাৎ করার জন্য অথবা নিজেরা ক্রেডিট নেওয়ার জন্য এই কাজটি করেছেন।’
তবে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেনের দাবি এই কাজগুলো ডাকসুর পরিবহন সম্পাদকের। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গণপরিবহন ও রিকশাভাড়া নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয় ডাকসুর পরিবহন সম্পাদকের কাজ। সেক্ষেত্রে কেউ যদি এগুলো নিয়ে কাজ করতে চায়, তবে পরিবহন সম্পাদকের সঙ্গে সমন্বয় করেই করতে হবে। আর ডাকসুর এজিএস হিসেবে জিএস’র অনুপস্থিতিতে অনেক কিছুতেই আমাকে সই করতে হয়। সে হিসেবেই বিবৃতিতে সই করেছি।’
এদিকে ডাকসুর সার্বিক বিষয়ে মূল্যায়ন জানতে জিএস গোলাম রাব্বানীকে একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। জিএস থাকা অবস্থায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারান গোলাম রাব্বানী। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডাকসুর জিএস হিসেবে তার থাকা না থাকা নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়। রাব্বানীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, বিলাসী জীবনযাপন, ঘুম থেকে দেরিতে ওঠার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে চলার অভিযোগও ছিল।
দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন ও পরবর্তী একবছরকে সফলতা ও ব্যর্থতা— দুটোর সমন্বিত রূপ বলে মনে করেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর। তার দাবি, দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন হওয়াটাই এক ধরনের বড় সাফল্য। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের উপকারে আসবে এমন কিছু কাজ আমরা করেছি। ক্যারিয়ারভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয়, যেগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য উপকারী- এমন কিছু কাজ ডাকসু করেছে।’
নুরের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যা- প্রথম বর্ষ থেকে বৈধ সিট দেওয়া, গেস্ট রুম সংস্কৃতির বিলোপ, জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করার কথা উল্লেখ ছিল। এগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে ডাকসু পুরোপুরি ব্যর্থ। দেখুন, ডাকসুর ২৫ জনের মধ্যে ২৩ জনই ছাত্রলীগের। হল সংসদগুলোতেও একই অবস্থা। তারা নিজেরাই এগুলো বাঁচিয়ে রাখার হর্তাকর্তা। সব মিলিয়ে তাদের বাইরে আমি ও সমাজসেবা সম্পাদকের পক্ষে সবকিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।`
এক বছরে ডাকসুর কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন জানতে চাইলে সভাপতি ও ঢাবি উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান এখনই এ বিষয়ে মূল্যায়ন করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এখনই নয়; সময় হলে জানাব।’
গত একবছরের ডাকসুর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয়হীনতার দিকটি বারবার উঠে এসেছে। বিশেষত, ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ২৩ জন প্রতিনিধির সঙ্গে ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে থাকা দুজনের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। আর প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিতদের মধ্যেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ডাকসুর গঠনতন্ত্রের (সংশোধিত) ৬ এর ‘গ’ ধারা অনুযায়ী, নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পদাধিকারগণের দায়িত্বকাল ৩৬৫ দিন বা একবছর। গত বছর ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের পর ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নির্বাচিত ২৫ প্রতিনিধি। সে হিসেবে চলতি মাসেই ডাকসুর কার্যকাল শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না।
পরবর্তী নির্বাচন কবে হতে পারে?- এমন প্রশ্ন করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে এখনই কিছু বলতে চাই না।’
এদিকে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন নির্বাচন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা দেখতে পাচ্ছেন বলে সারাবাংলাকে জানান। তিনি বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করুণা নয়। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার। আমরা এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এক ধরণের নিষ্ক্রিয়তা দেখতে পাচ্ছি। আমরা চাই, দ্রুত নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করে তফসিল ঘোষণা করা হোক।’