এপ্রিলে আরেক দফা বাড়বে পানির দাম
১২ মার্চ ২০২০ ০৮:২৯
ঢাকা: নগরবাসীকে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ব্যর্থতার অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হয়ে আসলেও সে সমস্যার সমাধান না করে আরেক দফা পানির দাম বাড়াচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। এর ফলে ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপতে বসছে আরও একদফা বাড়তি খরচের বোঝা।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, আবাসিক সংযোগে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির মূল্য ১৪ দশমিক ৪৬ টাকা এবং বাণিজ্যিক সংযোগে ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে ঢাকা ওয়াসা। আগামী ১ এপ্রিল থেকে এই নতুন দাম কার্যকর হবে।
এ বিষয়ে ওয়াসা বলছে, পানির উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য বিধান এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে ব্যয় সমন্বয় করতে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। মিটারবিহীন হোল্ডিং, গভীর নলকূপ, নির্মাণাধীন ভবন ও ন্যূনতম বিলসহ সব প্রকার (পানি ও পয়ঃ) অভিকরের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে।
এদিকে গত বছরের এপ্রিলে পানি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করেন।
এর আগে আবাসিকে ১ হাজার লিটার পানির দাম ছিল ১১ দশমিক ৫৭ টাকা, আর বাণিজ্যিক সংযোগে ছিল ৩৭ দশমিক ৪ টাকা। সে হিসেবে আবাসিকে বেড়েছে প্রতি হাজার লিটার পানিতে ২ দশমিক ৮৯ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ২ দশমিক ৯৬ টাকা।
তবে ওয়াসার আইন অনুযায়ী, ওয়াসার বোর্ড প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে এবার পানির দাম ২৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। এর আগে গত বছরের জুলাইতে পানির দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন ইউনিটপ্রতি ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছিল।
ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য পানির দাম ৮০ শতাংশ বাড়াতে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেয় ওয়াসা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেওয়া চিঠিতে ওয়াসা আবাসিক ব্যবহারের জন্য প্রতি ইউনিট বা ১ হাজার লিটার পানির দাম ১১ দশমিক ৫৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বর্তমান দাম ৩৪ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬৫ টাকা করার প্রস্তাব দেয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ঢাকা ওয়াসার পানির সংযোগ রয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৫১টি। এই সংযোগ থেকে ১ কোটির বেশি মানুষ পানি ব্যবহার করে। বর্তমানে ঢাকায় দৈনিক পানির উৎপাদন ২৪৫ কোটি লিটার। নগরবাসীর মোট চাহিদা ২৩০ থেকে ২৩৫ কোটি লিটার। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার ৩টি পানি শোধনাগার এবং ৯৩০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। তবে গভীর নলকূপ চালু রয়েছে ৮৭০টি। বর্তমানে ওয়াসার পানি উৎপাদনক্ষমতা ২৬০ কোটি লিটার। আর চাহিদা রয়েছে ২৩৫ কোটি থেকে ২৪০ কোটি লিটার।
এদিকে পানি নিয়ে তুলকালাম ঘটে গত বছরের এপ্রিলে। তখন কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের সামনে পরিবার নিয়েই মানববন্ধন করেন জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান। তার ইচ্ছা ছিল ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানকে ওয়াসার পানি দিয়ে বানানো এক গ্লাস শরবত খাওয়ানো। কিন্তু ওয়াসা এমডি তখন সাড়া দেননি।
পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পানির দাম যা রয়েছে তা উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম।’ তবে এর বেশি তিনি বলতে চাননি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পানির দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে সেটা যৌক্তিক না। এটার সঙ্গে এখন আবার বাড়ি ভাড়া বাড়বে। এদিকে বিদ্যুতের দামও বাড়ছে। ভোক্তাদের ওপর একপ্রকার বাড়তি চাপ ফেলবে। এর প্রভাবে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। আমরা আশা করছি সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দাম কমাবে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পানির দাম বাড়ানোর চেয়ে বড় কথা সুপেয় পানি দেওয়া। সেটা কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। আমরা আগেও বিষয়টি নিয়ে বলেছি এখনো বলছি, দাম বাড়ানোর চেয়ে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে হবে। সেটা না করে বারবার দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয়। আশা করি সরকার বিষয়টি দৃষ্টি দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে দাম কমাবে।’
পানির দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পানি সরবরাহে আমাদের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে কিছুদিন আগে পানির বিভিন্ন নমুনা নিয়ে টেস্ট করা হয়েছে। ছয়টা নমুনাতে নিম্নমান পাওয়া গেছে। তবে খারাপ কিছু পাওয়া যায়নি। আমাদের পানির সোর্স হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার। তবে পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। সেজন্য আমাদের বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে।’
এছাড়া পানি শোধনাগার প্লান্টগুলো অনেক ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রিভার ওয়াটার ট্রিটমেন্টের জন্য খরচ আছে। একই সাথে ২০৩০ সালের মধ্যে সবাইকে পানি দিতে হবে এবং কোয়ালিটি সম্পন্ন। সেইফ ওয়াটার, সেইফ স্যানিটেশন দিতে হবে। পানির মূল্য বাড়ানোর আগে তথা ফাইল স্বাক্ষর করার আগে বিভিন্ন দেশে খবর নিয়েছি। তাদের উৎপাদন খরচ কত? আমাদের সিস্টেম লস কত? সবগুলোকে আমলে নিয়ে দেখা গেছে আমাদের ২২-২৫ টাকা খরচ হয় উৎপাদনে। দিল্লীতে ৩২ টাকা, কোলকাতাতে বেশি আর পাকিস্তানে আরও বেশি। তবে আমাদের ১৪ টাকা ৬২ পয়সা করা হয়েছে সম্ভবত। তবে ওয়াসা প্রস্তাব দিয়েছিল প্রতি ১ হাজার লিটারে ২০ টাকা করার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাঁচ জনের একটি পরিবারের মাসে এখন পানির জন্য ৩৬ টাকা ব্যয় বেশি হবে। তবে আমার মনে হয় এটা বেশি না। তবে না বাড়ালে যে প্রতিষ্ঠানগুলো এই সেবাটি দিচ্ছে তারা সাসটেইন্ট করতে পারবে না। তাহলে আমরা পানি পাবো কিভাবে। আপনাদের মনে রাখতে হবে, ২০০৩ সালে বিএনপি আমলে চট্টগ্রামের হালি শহরে স্থায়ীভাবে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। আর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে আবার পানি সরবরাহ করা হয়। একই সঙ্গে আমরা ঢাকা শহরে ৬০ শতাংশ মানুষ পানি পেতাম না। তাই আমি মনে করি, পানির মূল্য বৃদ্ধি যৌক্তিক। সুতরাং আমাদের জন্য এটা পেইনফুল হবে না।’