এখনো চালু পর্যটন স্পট, বন্ধে নেই দৃশ্যমান উদ্যোগও
১৮ মার্চ ২০২০ ২০:৪০
ঢাকা: বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। বাংলাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পালন করা হয় সীমিত পরিসরে। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কোচিং সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকার এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, জনসমাগম যেন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা হয়। অথচ দেশের পর্যটন স্পটগুলো খোলা রয়েছে বহাল তবিয়তে। শুধু তাই নয়, এসব স্পটে চোখে পড়ছে উপচে পড়া ভিড়।
এ পরিস্থিতিতে বুধবার (১৮ মার্চ) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান নির্বাহী ক্ষমতাবলে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল পতেঙ্গা নয়, চলমান পরিস্থিতিতে পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ করে দেওয়া সময়ের দাবি।
বিভিন্ন পিকনিক স্পটের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ রাখার বিষয়ে তাদের কাছে এখনো কোনো সরকারি নির্দেশনা পৌঁছায়নি। নিজেদের উদ্যোগে সচেতনতা কর্মসূচি নিলেও সেটি কতটুকু পর্যাপ্ত, তা নিয়েও আছে ভাবনার অবকাশ। বিশেষ করে মঙ্গলবার (১৭ মার্চ) দেশের বিভিন্ন পিকনিক স্পট ও রিসোর্টে মানুষের উপচে পড়া ভিড় সবাইকে আরও শঙ্কিত করে তুলেছে।
গাজীপুরের পূবাইলে সরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে রাখা হচ্ছে বিদেশ ফেরতদের। ওই এলাকাতে রয়েছে বেশকিছু পিকনিক স্পট। তাদের একটি পূবাইল রিসোর্ট ক্লাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ফয়েজ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে আমাদের এখানে বড় যে অনুষ্ঠানগুলো ছিল, সেগুলো বাতিল করেছি। অনেকেই নিজের উদ্যোগে বাতিল করেছেন। আমরাও তাদের অগ্রিম হিসেবে দেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছি। কারণ আমাদের কাছে দেশের স্বার্থ আগে।
গাজীপুরের অদূরে পূবাইল সোসিও কালচার সেন্টারে (পিএসসিসি রিসোর্ট) ১৭ মার্চ একটি পিকনিকের আয়োজন ছিল। এ বিষয়ে রিসোর্টটির কর্মকর্তা দেওয়ান কামরুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এখনো রিসোর্ট বন্ধের কোনো সরকারি নির্দেশনা পাইনি। তবে আমরা আমাদের কর্মসূচিগুলোকে বিভিন্নভাবে সীমিত আকারে নিয়ে আসতে চেষ্টা করছি। অনেক অনুষ্ঠানই আমরা এখন আর গ্রহণ করছি না। ছোট আকারে কিছু অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হচ্ছে।
গাজীপুরেই আরেকটি রিসোর্ট জল ও জলের কাব্যের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বিদ্যারঞ্জন বাবুও জানান, নিজেরা সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিলেও সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন তারা পাননি।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম ব্যুরোর খবর অনুযায়ী, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার সরকারি ছুটির বিকেলে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের সময় এই জনসমাগম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ায়। এ নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হলে সিএমপি পতেঙ্গা সৈকতে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। মঙ্গলবার এমন দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা গেছে দেশের আরও অনেক এলাকাতেই।
দেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, জনসমাগম এড়িয়ে চলাটাই এখন নিরাপদ। আর এক্ষেত্রে যারা এখনো সেটি মানছেন না, তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের বিষয়টিও এখন সামনে এসেছে। এ সময়ে আসলে কোনো বনভোজন বা বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে না যাওয়া ভালো।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও দলে দলে এভাবে ঘুরতে বের হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বরে মন্তব্য করেন আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ও আইসিডিডিআরবি’র পরামর্শক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান।
তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তটি ভালো ছিল। তবে সেই বন্ধের মধ্যে এভাবে ঘুরতে বের হলে সেটা করোনাভাইরাসের বিপদের ঝুঁকি বাড়ায়। আসলে সবার সচেতন হতে হবে। কারণ ঘুরতে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বিদেশ ফেরত কেউ থাকলে তা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু যেহেতু এখনো কোনো সরকারি নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলা হচ্ছে, তাই এ ক্ষেত্রে বলা যায়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব আছে।
অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে দেখছি, তারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের নিয়ে কমিটি করেছে। তাদের নির্দেশনায় কাজ হচ্ছে। আমরা এখনো দৃশ্যমান এমন কিছু দেখিনি। খুব দ্রুত এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, স্কুল বন্ধ থাকার পর যদি কেউ বনভোজন বা অনুষ্ঠান করে, সেটি তো সবাইকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়ার মতো। এখন এসব ট্যুরিস্ট স্পট এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। জনগণ যদি নিজে থেকে সচেতন না হয়, তবে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানো কঠিন।
কেবল ট্যুরিস্ট স্পট নয়, জনসমাগম কমছে না কোথাওই। দেশের বেশকিছু এলাকায় বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন সামনে রেখে চলছে প্রচারণা। এলাকায় এলাকায় চলছে সভা, মাহফিল। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ের ঘাটতি আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সারাবাংলাকে বলেন, আমরা সবসময়ই সবাইকে বলে আসছি জনসমাগম এড়িয়ে চলার জন্য। সেটা কেউ না মানলে আমরা কঠোর হওয়ার কথা বলেছি। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে কিছু বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারি, কিছু ক্ষেত্রে একটু কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দিতে পারি। আমরা তো সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। যে কারণে মুজিববর্ষের অনেক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনেক কর্মসূচিও স্থগিত করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছে। তবে আমরা এখনো আলাদাভাবে কোনো নির্দেশনা দেইনি। আশা করছি সবাই নিজ নিজ স্থান থেকে সচেতন হয়ে কাজ করে যাবেন। আর তাই আলাদাভাবে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
আইইডিসিআর করোনাভাইরাস করোনার প্রাদুর্ভাব কোভিড-১৯ জনসমাগম জনসমাগম এড়ানো পতেঙ্গা পর্যটন স্পট