‘আতঙ্ক-অসহায়ত্ব’ নিয়ে প্রশিক্ষণে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা
২০ মার্চ ২০২০ ১৪:৩৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের জনসমাগম এড়িয়ে প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন এবং স্বাস্থ্য বিভাগ। অথচ নির্বাচন কমিশনই প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ভোট গ্রহনকারী কর্মকর্তার সমাগম ঘটিয়ে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। একেকটি কেন্দ্রে সরকারি-আধা সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিলিয়ে প্রায় এক হাজারেরও বেশি লোকের সমাগম ঘটিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
তিন ধাপে ১৬ হাজার ১৬৩ জন ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তার ছয়দিনের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে শুক্রবার (২০ মার্চ) থেকে। প্রথম ধাপে উপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক দেখা গেছে। এই ভয়-আতঙ্ক নিয়ে প্রশিক্ষণে উপস্থিত হওয়া নিয়ে তাদের চেহারায় ছিল অসহায়ত্ব। শুধু কি প্রশিক্ষণার্থী ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা, যারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও ছিল বাড়তি সচেতনতা আর উদ্বেগ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণের আয়োজন নিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন তারাও।
নগরীর যে চারটি ভোটকেন্দ্রে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- কুলগাঁও সিটি করপোরেশন স্কুল এন্ড কলেজ, সিডিএ পাবলিক স্কুল, খাজা আজমেরি উচ্চ বিদ্যালয় এবং পাহাড়তলী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ।
শুক্রবার সকালে নগরীর ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডের খাজা আজমেরি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ২৫টি শ্রেণীকক্ষে প্রশিক্ষণ চলছে। প্রতিটি কক্ষে ৩০ থেকে ৪০ জনের সমাগম হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থী কারও কারও মুখে মাস্ক আছে। হাতেগোণা দু’য়েকজনের কাছে স্যানিটাইজারও দেখা গেছে। অধিকাংশেরই নেই প্রতিরোধমূলক কিছু। মূলত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার ও ভোটগ্রহণ পদ্ধতি হাতেকলমে শেখাচ্ছেন প্রশিক্ষকরা। একেকটি ইভিএম ঘিরে ১০-১৫ জনের জটলা।
প্রশিক্ষণ নিতে আসা খাদ্য বিভাগের উপ-পরিদর্শক আশীষ ভৌমিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টায় ফোন করে বলেছে প্রশিক্ষণে আসেন। অথচ আমরা গত (বৃহস্পতিবার) রাতেও জানতাম, প্রশিক্ষণ স্থগিত হয়েছে। ফোন পেয়ে আসার পর নির্বাচন কর্মকর্তাদের এই পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছি। তারা বলেছেন, ভোট স্থগিত হবে, আপাতত ট্রেনিংটা নিয়ে নেন।’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারি প্রকৌশলী মো. রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কী চিন্তা করছে জানি না। এভাবে তো প্রশিক্ষণ হয় না। সবার মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। ভয় নিয়ে কি স্বাভাবিক কোন কাজ করা যায়?’
নগরীর আগ্রাবাদের ব্যাংক আলফালাহ’র হেড অব ব্রাঞ্চ আব্দুল মোর্শেদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ব্যাংকে কাস্টমার লিমিটেড করেছি। সরকার সিনেমা হল, গ্যাদারিং বন্ধ করছে। অথচ আমরা শত, শত মানুষ এখানে ট্রেনিং করতে এসেছি। এটা টোটালি রং ডিসিশন। আমি নিজেও অসুস্থ। আল্লাহ না করুক, এখানে কেউ যদি আক্রান্ত থাকেন, তাহলে সেটা আরও দশজনকে অ্যাফেক্ট করবে। আমি দুইবার নির্বাচন কমিশন অফিসে গেছি, বারবার জানতে চেয়েছি। তারপরও উনারা ট্রেনিং দিচ্ছেন। আমরা কি করব, উনাদের আদেশ তো আমাদের মানতে হবে। আমরা আসলেই অসহায়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আগ্রাবাদের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ট্রেনিং করতে এসেছি। আমার নিজের গায়েও জ্বর। তারপরও ছোট চাকরি করি। সরকারের নির্দেশ তো না মেনে পারি না। আমার ছেলে বাসা থেকে বারবার ফোন করে বলছে, আম্মু তুমি চলে আস।’
ফেনী থেকে প্রশিক্ষণ দিতে আসা একজন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সারাবাংলা’র কাছে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘আমার পুরো ফ্যামিলি টেনশনে আছে। আমাকে শনিবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে থাকতে হবে। এভাবে নির্বাচন হয় না। ভোটাররাও তো ভোটকেন্দ্রে আসবে না। তাহলে আমরা ১৫-২০ হাজার মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে কী লাভ বুঝিনা!’
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণার্থী কারও জন্যই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলার প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। কার্যালয়ের একজন কর্মচারিকে দেখা গেছে, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ডগ্লাভস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিজেরাই মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার কিনে এনেছি। অফিস থেকে কিছুই দেওয়া হয়নি।’
তবে খাজা আজমেরি স্কুলে দায়িত্বরত সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা দাবি করেছেন, সেখানে আগত সবার জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনির হোসাইন খান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, নির্বাচন স্থগিতের বিষয়ে কমিশন থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত তারা ভোটগ্রহণর প্রস্তুতি সংক্রান্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।
রিটার্নিং অফিসারে কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, অতিরিক্ত ৫ শতাংশসহ মোট ১৬ হাজার ১৬৩ জন ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ হবে। তিন ধাপে এই প্রশিক্ষণ চলবে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। দুইদিন করে প্রশিক্ষণের প্রতি ধাপে সাড়ে ৫ হাজার করে কর্মকর্তা অংশ নেবেন। প্রথমদিনে দক্ষিণ পাহাড়তলী, জালালাবাদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, মোহরা, পূর্ব ষোলশহর, উত্তর পাহাড়তলী, উত্তর কাট্টলী, পাহাড়তলী, পাঠানটুলি, পূর্ব মাদারবাড়ি ও গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত অতিরিক্ত ৫ শতাংশ বাদে মোট ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা ১৫ হাজার ৩৯৩ জন। এর মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার ৭৩৫ জন, ৫ শতাংশ অতিরিক্তসহ ৭৭২ জন। সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার ৪ হাজার ৮৮৬ জন, ৫ শতাংশ অতিরিক্তসহ ৫ হাজার ১৩০ জন, পোলিং অফিসার ৯ হাজার ৭৭২ জন, ৫ শতাংশ অতিরিক্তসহ ১০ হাজার ২৬১ জন।