এলাকাভেদে বদলে যায় স্কুল-কলেজের স্যানিটেশন ব্যবস্থা
২৩ মার্চ ২০২০ ১৫:২৮
ঢাকা: রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাথরুমের সংখ্যা পর্যাপ্ত হলেও সেগুলোর ব্যবস্থাপনা খুব একটা সুবিধার নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই বাথরুম নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নেই সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থাও।
গত কয়েকদিনে রাজধানীর ৩০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, অভিজাত এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্যানিটেশনের গোছানো ব্যবস্থা থাকলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে এই ব্যবস্থা খুবই শোচনীয়। পুরনো ঢাকার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থা।
পুরনো ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে লালবাগের সরকারি মডেল স্কুল ও কলেজের অবস্থায়। এখানে শিক্ষার্থীরা যে বাথরুম ব্যবহার করেন, সেটি রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ধরনের যত্নের ছাপ নেই। এমনকি এখানে বাথরুমে হাত ধোয়ার জন্য সাবানও দেওয়া হয়নি। বাথরুম ভয়াবহ রকমের নোংরা। তার সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থা তো নেই-ই।
তবে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ করা বাথরুমগুলোতে সব ধরনের সুবিধাই রাখা হয়েছে।
শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য বাথরুম আছে দু’টি। একাডেমিক ভবনের তিন তলায় বাথরুমের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও নিচ তলার বাথরুমের অবস্থা শোচনীয়। পাশেই পানি খাওয়ার জন্য কল রয়েছে। তবে এই প্রতিবেদক যেদিন গিয়েছিলেন কলেজটিতে, সেদিন পানিই ছিল না লাইনে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের অন্ত নেই। তবে এ প্রতিষ্ঠানটিতেও শিক্ষকদের জন্য চমৎকার স্যানিটেশনের ব্যবস্থা রয়েছে।
বোরহান উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী অঞ্জুমান সারাবাংলাকে বলেন, এই অবস্থার কারণে সকাল বেলা বাথরুমে না যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও সারাদিন ক্লাস করে একেবারে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হতে হয়। এখানে পানির যে ব্যবস্থা আছে, শিক্ষার্থী সংখ্যার তুলনায় সেটি একেবারেই অপ্রতুল।
সেগুনবাগিচা এলাকায় আইডিয়াল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য দু’টি ওয়াশরুম রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়াশরুম মাত্র একটি। সেটিও বিচ্ছিরি রকমের নোংরা। বাথরুমের পাশেই দু’টি বেসিন, যেখান থেকে বাধ্য হয়েই পানি পান করতে হয় শিক্ষার্থীদের। একই পরিস্থিতি সেগুনবাগিচা হাইস্কুলেও।
এছাড়াও আজিমপুর চৌধুরী বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মোটামুটি মানের ওয়াশরুম রয়েছে। তবে সেটিও কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। তবে পানি পানের ব্যবস্থাটুকু রয়েছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র বেশ আলাদা। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি গার্লস স্কুল, উদয়ন স্কুল ও কলেজ, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজে সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থা চমৎকার। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বাথরুমের ব্যবস্থাও শিক্ষকদের সমমানের। এজন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই সারাবাংলার কাছে নিজেদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছেন। তবে একই এলাকার নীলক্ষেত হাইস্কুলের সার্বিক পরিস্থিতি এই তিন প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কিছুটা খারাপ।
স্কুলগুলো পরিচ্ছন্ন করে রাখলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরের পরিবেশ নোংরা করে রেখেছেন কর্তৃপক্ষ। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতায় নোংরা ও নাজুক অবস্থায় রয়েছে হলগুলোর শৌচাগার। পানির ট্যাপগুলোও নোংরা। কলা ভবন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ফ্লোরের বাথরুমগুলোর পরিস্থিতি খারাপ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ভিকারুননিসা স্কুল ও কলেজের আজিমপুর ও সিদ্ধেশ্বরী শাখায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজেদের ক্যাম্পাসের স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে তারা যথেষ্টই খুশি। তবে জীবাণুনাশক সাবান ও স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরি করতে শিক্ষকদের কাছে দাবি জানিয়ে রেখেছেন এসব শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।
রাদীদ জামান চৌধুরী নামে একজন অভিভাবক সারাবাংলাকে বলেন, ঢাকার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ভিকারুননিসাকে অভিজাত বলা যায়। এখানে বাথরুম ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো। তবে শিক্ষার্থীদের যদি সুনিপুণভাবে হাত ধোয়ায় উৎসাহিত করা যেত, তাহলে আরো ভালো হতো। বিশেষ করে করোনাভাইরাস নিয়ে চলমান আতঙ্কের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি সচেতন হওয়া জরুরি।
ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফাওজিয়া রেজওয়ান বলেন, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের মতো শারীরিক সুস্থতার দিকেও আমাদের দৃষ্টি রয়েছে। এজন্য প্রতিটি বাথরুমে নতুন করে জীবাণুনাশক সাবান দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আমরা হাত ধোয়ার পাশাপাশি সবসময় পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যাপারেও উৎসাহী করে তুলছি। পুরো বিষয়টিকে এখন আমাদের কাছে প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীদের পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করছি। কারণ এটি সুস্থ থাকার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। সম্প্রতি আতঙ্ক ছড়ানো করোনাভাইরাস বিষয়েও আমরা লিফলেট বিতরণ করেছি। আমাদের বিদ্যালয়ের প্রতিটি বাথরুম নিট অ্যান্ড ক্লিন। তারপরও এসবের রক্ষণাবেক্ষণে এখন আরও বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
এই দুই অধ্যক্ষই পরিবার থেকে শিশুদের বাথরুম ব্যবহার করা শেখানো, বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখতে উদ্বুদ্ধ করা এবং জেন্ডারবান্ধব স্যানিটেশন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, প্রয়োজনের সময় বাথরুম ব্যবহার করাটা একজন মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। বিদ্যালয়গুলোকে এ ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। না হলে এরকম মহামারির সময় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে।
তিনি আরো বলেন, এমনিতেই কিশোর বয়সে স্কুলের বাথরুম ব্যাবহার করতে শিক্ষার্থীরা কিছুটা লজ্জা পায়, বিশেষ করে কিশোরীরা। যে কারণে পিরিয়ড চলাকালীন অনেক মেয়ে স্কুলে যায় না। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা ও অপসারণের ব্যবস্থা, প্রতিটি বিদ্যালয়ে কিচেন রাখা, হাইজেনিক ল্যাট্রিন রাখার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইডের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৬৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাত ধোয়ার উপকরণ নেই। ৮৬ শতাংশ বিদ্যালয়ে টয়লেট থাকলেও অর্ধেকের বেশি বাথরুম প্রয়োজনের সময় বন্ধ থাকে।
এই পরিসংখ্যানের পাশাপাশি এই প্রতিবেদকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাস্তব পরিস্থিতি হয়তো আরও বেশি খারাপ। তবে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে বিষয়টির সমাধান সম্ভব। মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই যত্ন নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়েও সমানভাবে ভাবতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।