Sunday 20 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণহত্যার ভয়াল সেই রাত


২৫ মার্চ ২০২০ ০০:২০

ঢাকা: আজ বুধবার, ভয়াল ২৫ মার্চ। জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন শুরু করে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

দিনটি উপলক্ষে প্রতিবছর ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও এবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

২৫ মার্চের ভয়াল এই রাত বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। তবে এ রাতে যে নির্মম গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ মহান জাতীয় সংসদে এ দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরে ২০ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ এই দিব্সকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় আরও ৩০০০ লোক। ঘটনার শুরুটা ঢাকায়, এরপর সারা পূর্বপাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা মরদেহের সংখ্যা বাড়িয়ে চলতে থাকে। জ্বালাতে শুরু করে ঘর-বাড়ি। দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হয় যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মরদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।

এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়— ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস বলে, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানি জান্তার এই কুখ্যাত অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ-ট্রাক বোঝাই করে নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তানি সৈন্যরা সমরাস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে আধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা। শুরু হয় বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ, ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডব। হতচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্তের ঢল নামে। মানুষের কান্না আর আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে শহরের আকাশ। মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হয় লাশের শহরে।

ঢাকা শহরের রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে বাঙালি নিধন হয় সে রাতে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল ৫০ হাজারেরও বেশি বাঙালিকে। মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হয় এক কালিমালিপ্ত অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের ওপর চালানো এ বর্বরতায় স্তম্ভিত হয় বিশ্ববিবেক।

নিষ্ঠুর ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। পাক হানাদাররা সেই রাতে অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুঁড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ছাড়াও জাতীয় প্রেস ক্লাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও জান্তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পাননি। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের ৯ শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তাদের এই সশস্ত্র অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল একটিই— বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করা।

সেদিন রাত সোয়া ১টার দিকে একদল সৈন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধু বীরের মতো দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। এ সময় বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাতের জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল। অবশ্য গ্রেফতার হওয়ার আগেই ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। আর এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছে যায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের তৎকালীন শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। সেই থেকেই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস।

ভয়াল সেই রাত শেষ সকাল হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে। এরপর বাঙালি ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনে বিজয়।

২৫ মার্চ একাত্তরের ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ভয়াল ২৫ মার্চ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর