করোনা প্রতিরোধে সচেতনতার নজির গড়লেন আরাফাত!
২৭ মার্চ ২০২০ ২৩:১৬
ঢাকা: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যখন ছুটির ঘোষণা আসলো, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ রাজধানী ছাড়ার পথ খুঁজছে। জনসমাগম এড়িয়ে হোম কোয়ারেনটাইনের নির্দেশের পরপরই লাখো মানুষের ঢল তখন আছড়ে পড়ে রেলস্টেশন, ফেরিঘাট আর বাসস্ট্যান্ড গুলোতে। করোনা আতঙ্কে বাড়ি ফেরার এই পথেই সবাইকে অবাক করে তখন সচেতনার নজির গড়েছেন এক শিক্ষার্থী।
সাইকেলে চেপেই সড়কপথে রাজধানী থেকে পঞ্চগড় পাড়ি দিয়েছেন এই তরুণ! প্রায় ৪৪৩ কিলো মিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন প্যাডেল ঘুরিয়ে!
সামাজিক দূরত্ব বজায় ও জনসমাগম এড়িয়ে জনসচেতনতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই শিক্ষার্থী। তার নাম ইয়াসির আরাফাত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্দান ইউনিভার্সিটির আইন বিষয়ের স্নাতকোত্তরের এই শিক্ষার্থী সাইকেলে করে রোদ-বৃষ্টিবাদল মাথায় নিয়ে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে নিজের পৈত্রিকনিবাসে পৌঁছেছেন পাক্কা চারদিনে!
ছুটির ঘোষণায় একদল উৎসুক যখন বাড়ি ফেরার পথে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়ি ফেরায় ব্যস্ত তখন এমন নজির সত্যিকার অর্থেই অনুকরণীয়। তবে কিভাবে সেই দু:সাহসিক সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের মুখেই জানালেন, ‘সাইকেলে বাড়ি আসবো ইচ্ছাটা সাইকেল যখন কিনি তার পরে থেকেই। দুই বছর হইলেও কাজটা করা হয় নাই। ১৯ তারিখ রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি আসবো সাইকেলে। কারণ এই সময়টাই সবচেয়ে বড় সময় যখন বেশিরভাগ মানুষই জনসমাগম এড়াতে পারছে না।’
পরেরদিন সাইকেল ঠিকঠাক করেই ব্যাগে স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাপিয়ে বিকেলেই শুরু হলো আরাফাতের সাইকেল যাত্রা। টি-শার্টের সামনে লেখা ‘বি সেফ, লেটস সেভ’। পেছনে ‘প্রোটেস্ট করোনা’।
প্রথম দিনেই টানা ১১ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে গেলেন আরাফাত। ১৫/২০ কি:মি: পরপরই অবসাদ মেটাতে বিশ্রাম নিয়েছেন। প্রথম দিনের যাত্রার কথাগুলো বলছিলেন আরাফাত, ‘প্রথম দিন মোটামুটি রাত ৩টা পর্যন্ত চালাই। সারাদেশে এইড লেনের কাজ চলতেছে।বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত মোটামুটি কাজ হয়ে গেছে। একটা লোকাল লেন ছিল, যেটা রাতে ফাঁকায় ছিলো। একাই ছিলাম কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি। ১৫/২০ কিলো পরপরই থামছি কোনো চায়ের দোকানে। নেমেই হাতে সেনিটাইজার নিয়ে নিতাম।’
যেতে যেতে বিশ্রামের সময় সাইকেলযোগে এই শিক্ষার্থীকে দেখে আগ্রহী মানুষদের সচেতন করে আবার যাত্রায় নেমে পড়তেন আরাফাত, ‘মানুষ দেখেই জিজ্ঞেস কই থেকে আসতেছি, কই যাচ্ছি? ৫/১০ মিনিট গল্প করে, সবার হাতে হেক্সিসল দিয়ে আবার চালানো শুরু।’
সাইকেল চালিয়ে লাখো প্যাডেল ঘোরানোর কাজটা মোটেও সহজ নয়। মাঝে প্রথমদিন অ্যালেঙ্গায় পৌঁছে যান। একটা রুম ব্যবস্থা করে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা দেন আরাফাত, প্রথম দিন অ্যালেঙ্গা পর্যন্ত চলে আসছি। সেখানকার একজন নাইট গার্ডের সঙ্গে কথা বলে একটা রুম পাইলাম। ৩ ঘণ্টা ঘুম দিয়ে আবার রওনা দিলাম সকাল ৭ টায়। বঙ্গবন্ধু সেতু সাইকেলসহ পার হলাম ট্রাকে। বগুড়া আসতে আসতে দুপুর ২ টা বাজলো।’
দ্বিতীয় ও তৃতীয়দিন কিভাবে কাটলো সেই গল্পটাও জানালেন আরাফাত, দ্বিতীয় দিন বগুড়ায় আমার তন্ময় ভাইয়ের বাসায় কাটলো। তৃতীয় দিন আসলাম রংপুর পর্যন্ত এসে শাকিল ভাইয়ের বাসায় ছিলাম।’
চতুর্থ দিনেই রংপুর থেকে একটানা প্যাডেল ঘুরিয়ে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে পৌঁছে যান তিনি। ওখানেই পৈত্রিক ভূমি।
সাইকেল যোগে বাসায় পৌঁছার আসল কারণের পেছনে ছিল তার পরিবারের সুস্থতা জানালেন তিনি, ‘সুস্থ থাকার জন্য বাড়ি এসে নিজের পরিবার বা এলাকার অসুস্থতার কারণ হইলে কি লাভ? সংক্রমণ এড়াতেই তো সবকিছু বন্ধ করার নির্দেশ। জনসমাগম এড়িয়ে নিজের সুস্থতা, পরিবারের সুস্থতা সঙ্গে প্রতিবেশীদের জন্যও থ্রেটের কারণ হতে হলো না।’
লাখো বাড়ি ফেরার এই দৃষ্টান্ত মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনা গড়ে তুলবে বিশ্বাস আরাফাতের। নিজে নিরাপদ আর সাবধান থেকে অপরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটু মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এভাবে এমন দেশে কতজনই বা ভেবে থাকেন?