স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ সম্মেলন নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন
১ এপ্রিল ২০২০ ১২:৩১ | আপডেট: ১ এপ্রিল ২০২০ ১২:৩২
সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস বা (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি নিয়ে নানাভাবে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রতিদিন গণমাধ্যমে ব্রিফ করে যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়মিতভাবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আসছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে প্রতিদিনের তথ্য জানানো হয়ে থাকে, যা জানার জন্যে অপেক্ষা করে সারাদেশ।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে ও গণমাধ্যমের কর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানিয়ে এই ব্রিফিংয়ের ধরনে আনা হয় পরিবর্তন। ২৩ মার্চ থেকে এই ব্রিফিং আয়োজন করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পরে এই ব্রিফিং আয়োজন করা হয় ‘জুম’ নামের আরেকটি যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু অধিদফতরের পক্ষ থেকে আয়োজন করা এই ব্রিফিংয়ে কারিগরি দুর্বলতা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে খোদ গণমাধ্যম কর্মীরাই বিব্রত হয়ে পড়ছেন।
মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানানো হয় দুপুর ১২টায় ব্রিফিং করা হবে। গণমাধ্যমকর্মীরাও সেই সময়ে অপেক্ষা করছিলেন। অনেক সময় অপেক্ষার পরে ব্রিফিংয়ে আসেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস পরিচালক ডা. মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, ব্রিফিং বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত হবে।
বিকেল ৩টায় ‘জুম’ ব্যবহার করে ব্রিফিং শুরু হয়। ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন এমআইএস পরিচালক ডা. মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। ব্রিফিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠ করার এক পর্যায়ে দেখা যায় কোনো শব্দই পাওয়া যাচ্ছিল না। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা অভিযোগ করলেও তা কর্ণপাত করেননি কেউই। পরবর্তীতে জানা যায় আসলে গণমাধ্যম কর্মীদের করা অভিযোগ আসলে কর্মকর্তাদের কানেই পৌঁছায়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আয়োজিত এই ব্রিফিং প্রায় প্রতিদিনই কিছুটা অগোছালো অবস্থায় চলছে। ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের উত্তরও দেওয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগও আছে অনেকের মাঝে। আর এতে করে বিভ্রান্তি বাড়ছে জনমনে। একই সঙ্গে গুজব সৃষ্টিতেও সাহায্য করছেন বলে মনে করছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সভাপতি তৌফিক মারুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ব্রিফিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা চাই উপযুক্তভাবে কারিগরি সহায়তাগুলো অবিলম্বে কাটানো হোক। প্রয়োজনে যারা এই ধরণের ব্রিফিংয়ের জন্য দক্ষ তাদের সাহায্য যেনো নেওয়া হয়ে থাকে। যারা কারিগরি ত্রুটিগুলি কাটিয়ে একটি গোছালো ব্রিফিং ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজন হলে সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নিয়ে যেনো ত্রুটিমুক্তভাবে এই ব্রিফিং করে। সেটা না হলে এই ব্রিফিং নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরণের বিভ্রান্ত তৈরি হয়। সাংবাদিকরাও কোনো প্রশ্ন করতে পারে না যেটি আমাদের কাছে কাম্য না। এমন বিষয় আমরা আশা করি না। এ বিষয়ে তাদেরকে আগেও আমরা সতর্ক করেছি যাতে তারা পরিপূর্ণ কারিগরি সহায়তা নিয়ে এই ব্রিফিং করে। সেটি তারা আসলে এখনো ঠিক ভাবে করছে না। এটা নিয়ে আমাদের এক ধরণের অসন্তুষ্টি আছে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর হয়তো বা এখনো এই ব্রিফিংকে গুরুত্বসহকারে দেখছে না। যে কারণে ২৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত তারা ত্রুটিমুক্ত হতে পারছে না। এটা এক ধরনের ব্যর্থতা।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এখন সামাজিকভাবে এক ধরণের দূরত্ব বজায় রাখার বিষয় আছে। সেই কারণে আগে যেভাবে প্রেস ব্রিফিং হতো সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রে যে প্রেস ব্রিফিংগুলো হচ্ছে সেখানেও দূরত্ব বজায় রেখে করা হচ্ছে। আমাদের হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের পক্ষ থেকে উনাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যেনো বড় কোনো অডিটোরিয়ামে আমরা এই ব্রিফিং করতে পারি। উনারা ২২ মার্চ সেভাবেই করেছিলেন। এরপরে আর করেননি। ওইটা হলেও আসলে ব্রিফিংটা এমন হতো না। এভাবে একটা ব্রিফিং না করে যদি উনারা একটা বিস্তারিত আকারে প্রেস রিলিজ দেয় তাও আমরা যারা বর্তমানে কোভিড-১৯ নিয়ে কাজ করছি তাতেও কিন্তু আমাদের হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখন যেভাবে করছে একটা বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে সেখানে প্রায়ই দেখা যায় যে নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অনেক কথা শোনা যাচ্ছে না। আবার দেখা যাচ্ছে যাদের প্রয়োজনীয়তা নেই এমন মানুষও এখানে কানেক্ট হচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে এই ব্রিফিং একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম কর্মী যারা এটা নিয়ে কাজ করেন তারা সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যে কারণে আজকেও আমি দেখেছি কিছু স্থানে আইসোলেশন ও কোয়ারেনটাইনের সঠিক ব্যাখ্যা না দিয়ে বিভ্রান্তকর তথ্য দেওয়া হচ্ছে। হয়তো বা বোঝার ভুলের কারণে একেক জন একেক রকম তথ্য দিচ্ছে। আর তাই আমি মনে করি এ ধরণের বিভ্রান্ত এড়ানোর জন্য উনারা বড় কোনো অডিটোরিয়ামে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ব্রিফ করতে পারেন। অথবা বিস্তারিত আকারে একটা প্রেস রিলিজ দিয়ে দিতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, এখন কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়ার পত্রিকা বাদেও অনলাইন পত্রিকা প্রায় সবাই পড়ে থাকেন। আর এক্ষেত্রে যদি সবাই পুরো বিষয়টি না বুঝে যদি কিছুটা তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে সেক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর কোনো তথ্য মানুষকে আতঙ্কিত করতে পারে। এটার সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করি। যেভাবে ইদানিং অ্যাপস ব্যবহার করে উনারা ব্রিফিং করছেন সেখানে বিভিন্ন জন সংযুক্ত হচ্ছেন। দেখা গেলো একই বিষয়ে একেক জন একেক ধরণের কথা বলছেন। তিনজন পরিচালক তিন ধরণের কথা বলছেন আবার দেখা গেলো মন্ত্রী যোগ হয়ে অন্য কথা বলছেন। এগুলো বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। একটা প্রতিষ্ঠান থেকে একই তথ্য আসা উচিত। সেই তথ্য বস্তুনিষ্ট হওয়া উচিত। আর তাই আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে বিভ্রান্তি ছড়ায় এমন ব্রিফিং বাদ দিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ব্রিফিং হওয়া উচিত নতুবা একটা তথ্য সম্বলিত প্রেস রিলিজ দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) কার্যনির্বাহী সদস্য নূরুল ইসলাম হাসিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুম ব্যবহার করে যে ব্রিফিংটা করা হয়ে থাকে তা কিন্তু জটিল কোনো টেকনোলজি না। এটা যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। আমার কাছে মনে হচ্ছে ব্রিফিংটা আসলে উনারা তেমন সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছেন না। আগে হতো এক জায়গায়, এখন আরেক জায়গায়। আগে একজন পরিচালক ব্রিফ করতেন আর এখন দুইজন পরিচালক ব্রিফ করেন। উনাদের এখন অনেক কাজ সেটাও মানি। সেক্ষেত্রে উনাদের যদি সমস্যাও হয়ে থাকে তবে আমাদের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাহায্যেও এই ব্রিফিং আয়োজন করা যেতে পারে। সেটাও যখন করা হচ্ছে না তখন সেটাকে কিছুটা দায়সারা গোছের ব্রিফিং বলা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের অনেক জিজ্ঞাসা থাকে। আমরা সাংবাদিকরা যে প্রশ্নগুলো করে থাকি যারা ব্রিফিং করছেন তাদের কাছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে যদি তারা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে থাকেন তবে মানুষের মধ্যে আরও ভীতি বেড়ে যাবে। আর তাই মনে হচ্ছে উনারা এই বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব সহকারে দেখছেন না। কিন্তু এ সময়ে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এমন অবস্থায় যদি উনারা যথাযথভাবে প্রশ্নের উত্তর না দেন মানুষের মধ্যে ভীতি বেড়ে যাবে। কারণ সাধারণ মানুষদের তথ্যের উৎস কিন্তু সাংবাদিকরাই। এমন অবস্থায় এই ধরণের ভুল ভ্রান্তি কাটিয়ে একটি গোছালো সংবাদ সম্মেলন উপহার দিবেন উনারা এটাই আশা করি।’
বাংলা অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদক জুলফিকার রাসেল বলেন, ‘অনলাইনের প্লাটফর্ম আসলে অনেক বিস্তৃত একটি জায়গা। তবে কারিগরি ত্রুটি খুব দ্রুত সারিয়ে নেওয়া উচিত। তথ্য প্রযুক্তির যুগে এমন সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আর তাই সেটি খুব দ্রুত করা উচিত। আর সেগুলো কাটিয়ে উঠে একটি পূর্ণাঙ্গ আকারে ভালো সংবাদ সম্মেলন হতে পারে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ‘ব্রিফিংটি আয়োজনের ক্ষেত্রে কারিগরি দিকগুলি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকেই কাজ করা হয়ে থাকে। আর এক্ষেত্রে কারিগরি ত্রুটির বিষয়েও স্বীকার করে নেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। খুব দ্রুতই এ বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করবেন বলেও জানান তারা।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (এমআইএস) ডা. মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে ত্রুটিগুলো হয়েছে বা হচ্ছে আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই সেগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে।’
সারাবাংলা/এসবি/এমআই