বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে কী আছে?
১ এপ্রিল ২০২০ ১৭:৩৫
দুনিয়াজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কাল। সারাবিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে এই মহামারি। মৃত্যুর তাণ্ডব চলছে দেশে দেশে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আট লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এই ভাইরাসে। লাশের সারি চল্লিশ হাজারের বেশি। চীনে শুরু হলেও ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় মৃত্যুর মিছিল ডেকে এনেছে করোনাভাইরাস। অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি অনেকখানিই নিয়ন্ত্রণে আছে বলা চলে। কিন্তু অবহেলা চলবে না তাই বলে। করোনা প্রতিরোধে সময় এখন সতর্কতার, প্রতিরোধের, নিয়ন্ত্রণের।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে নানা দেশি-বিদেশি সংস্থা। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডাব্লিউএইচও) বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিতই। এর মধ্যে সর্বশেষ জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র ‘বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি: প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশ্বে উদ্ভূত করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং করণীয় বিষয়ক ওই প্রতিবেদনের কথা। জাতিসংঘের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, নাগরিক সমাজের বেশকিছু অংশীদার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ওই পরিকল্পনা নথি তৈরি করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ওই পরিকল্পনা নথি তৈরির উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির প্রেক্ষাপটে সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘের সংস্থা ও অংশীদারদের কার্যকরভাবে প্রস্তুত করা।
করোনা বিষয়ক যত আশঙ্কা আর আশাবাদ
জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র জানায়, সারাবিশ্বের মতোই বাংলাদেশে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য জলদি কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জনগণের প্রতি প্রতিরোধমূলক সব ব্যবস্থা মেনে চলার আহ্বান জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, সরকার, জাতিসংঘের সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশব্যাপী স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও জোরদার করার জন্য কিছুটা সময় পাবে। আর তার ফলে বাংলাদেশ এই মহামারি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারবে বলেও প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক স্বীকৃত যে মডেল পদ্ধতির সাহায্যে নথিটি তৈরি করা হয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে— এই ভাইরাসটির বিস্তার রোধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এই মহামারির কতটা বিস্তার ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
‘বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি: প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা’ নথির শুরুতেই করোনাভাইরাসের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ও ভয়াবহতা অনুধাবন করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এটি এমন একটি প্রাণঘাতী রোগ যা আমাদের সাড়া দেওয়ার গতির চেয়ে বেশি গতিতে সংক্রমিত হয়। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পরেছে মানুষ। সঙ্গে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ংকর ভাইরাস করোনাও। ৭৭০ কোটি জনগোষ্ঠীর এই বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রমণের হার উচ্চ ও আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মাত্রার জনঘনত্ব বিবেচনা করে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত পন্থা অবলম্বন করে ধারণা করা যায়, এখনই প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেওয়া না হলে মহামারির প্রভাবে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।
প্রতিবেদনে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি বিষয়ক বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মডেলের হিসাবে বলা হয়, বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটলে এবং তা প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, করোনা প্রতিরোধে সামান্য দেরিও বিশ্বের দেশে দেশে করোনা ভাইরাসে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা দুর্বল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাই নেই। এসব কারণে মহামারি রোধ করা কঠিন হবে। কোভিড-১৯ সংক্রমিত হলে অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসাও বাধাগ্রস্ত হবে। রোগীর ঘনত্বের তুলনায় দক্ষ স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর অভাব বাংলাদেশে প্রবল। এছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত অনুশীলন ও দক্ষতার অভাব, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) অপ্রাচুর্যতা, রোগীর বহুল ঘনত্ব মিলিয়ে করোনা মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য বেশ কঠিন হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রচলিত সামাজিক আচার ও মেলামেশার কারণে করোনা মহামারিতে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা এখানে প্রবল। তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে অতি দ্রুত সরকার বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক কোয়ারেনটাইন ও আইসোলেশন। তবে ভাইরাসটির ঝুঁকির ব্যাপারে ব্যাপকভাবে অবহিত করা, সামাজিক দূরত্ব, সামাজিক সুরক্ষার জন্য জনসমাগম হয়— এমন স্থানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার হার কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তার সঙ্গে জাতিসংঘ সম্পূর্ণভাবে একমত ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলেও তথ্যকেন্দ্রের প্রকাশিত পরিকল্পনা নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র জানায়, সরকারের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা ইতিবাচক হলেও দ্রুতই তা নেতিবাচক হতে দেরি হবে না, যদি না সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। সামান্য ভুলে মহামারি তীব্র হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
নিয়ন্ত্রণে সুযোগের জানালা এখনো খোলা
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়নে জাতিসংঘের নথিতে সুযোগের জানালা এখনো খোলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নথিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ ছড়ানোর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এখনো অজানা। তবে সরকারের দেওয়া দাফতরিক প্রতিবেদনের বিপরীতে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মডেলের পূর্বাভাস উদ্বেগ কমতে দিচ্ছে না। করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে অতি সতকর্তার কোনো বিকল্প নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আশঙ্কার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর দেশব্যাপী পরীক্ষার ক্ষমতা এখনো সীমিত এবং উন্নতি আশানুরূপ নয়। এছাড়া ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগেই ঢাকা থেকে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ গ্রামে কিংবা মফস্বলে চলে গেছে বলে ধারণা করা হয়। করোনার গতিপ্রকৃতির কারণে বিদেশ ফেরতসহ বিপুলসংখ্যক মানুষ একসঙ্গে ঢাকা ছাড়ার কারণে অনেকেই সংক্রমিত হয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে।
করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট কৌশল
করোনা সংক্রমণের প্রভাব কমাতে কিছু সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়নের প্রস্তাব দেওয়া আছে প্রতিবেদনে। এজন্য সরকারিভাবে অপেক্ষাকৃত তরুণ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, কমিউনিটি ক্লিনিক সক্রিয় করা, এনজিওর মাধ্যমে জাতীয়ভাবে সব পদক্ষেপ সক্রিয় রাখাই বড় পদক্ষেপ হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া টেলিযোগাযোগ অপারেটরদের মাধ্যমে সারাদেশে একটি উন্নত পর্যায়ের সহযোগিতা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করার কথা সুপারিশ করা হয়েছে। এই কেন্দ্র থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিতে সচেতনতা বাড়ানোসহ করোনা সংক্রমণের বিষয়ে দ্রুত সঠিক তথ্য রাখতে বলা হয়েছে।
প্রান্তিক পর্যায়ে সংক্রমণ কমানো এবং স্বাস্থ্য সুবিধা দ্রুত প্রস্তুতের বিষয়ে তাগাদা দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, করোনা পরীক্ষার সুবিধাগুলো এখনো জাতীয়ভাবে পাওয়া সহজ হয়নি, তবুও পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ, জাতীয় যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার কমাতে কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপগুলো হলো—
চলমান সুবিধা ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে দেশব্যাপী করোনা আক্রান্তদের অনুসন্ধান এবং শনাক্তকরণ শুরু করা; প্রান্তিক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগের পাশাপাশি হটলাইনের (৩৩৩) মাধ্যমে লক্ষণ মূল্যায়ন করা; যাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ পাওয়া যাবে, তাদের দ্রুত পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা; সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সন্দেহজনক সংক্রমিত ব্যক্তিকে দ্রুত করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রে নেওয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন পদক্ষেপ নিতে না পারলে অনেকেরই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। প্রতিরোধের কাজগুলো করবে কমিউনিটি ক্লিনিক, ব্র্যাক কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, মেডিকেল ছাত্র, ইন্টার্ন ডাক্তার, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা। আক্রান্তদের বাড়িতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনভিত্তিক শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। গুরুতর রোগীকে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, বর্তমানে করোনা পরীক্ষায় যে ব্যবস্থা আছে, তা একেবারেই অপ্রতুল। জাতীয়ভাবে রোগ নির্ণয় ও নির্ভুলতার জন্য পরীক্ষায় নিযুক্তদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে যারা থাকবেন, তাদের কে কোন অবস্থানে থাকবেন, কিভাবে নিরাপদ থাকবেন সে বিষয়ে জরুরি ও সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়া দেশব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে হাসপাতালে অন্যান্যদের সহায়তা করার জন্য সাপ্লাই ইন কমান্ড সচল রাখতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের পিপিই সরবরাহ ও গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার জন্য স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। বৈশ্বিক সরবরাহে ঘাটতির কারণে আমাদেরকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সমাধানগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে হবে এবং তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে।
আরও বলা হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য সরকারের নেওয়া ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। সংক্রমণের হার নির্ধারণের জন্য পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে সংক্রমণের হার যথেষ্ট কম আছে, এখনই হাসপাতালোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে মহামারিতে পরিণত হবে। বিশ্বব্যাপী করোনার বিস্তার সর্ম্পকে এরই মধ্যে শিখেছে বাংলাদেশ। তাই করোনা যেন মহামারিতে পরিণত হতে না পারে, সেজন্য অতি দ্রুতই করোনার বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে।
করোনাযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহ: যত বেশি সম্ভব, যত দ্রুত সম্ভব
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতিসংঘের পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের প্রস্তুতিতে সামগ্রিক অর্থায়ন দেখানো হয়েছে প্রায় তিন হাজার দুইশ পঞ্চাশ কোটি টাকা (তিনশ আটাত্তর কোটি মার্কিন ডলার)। এই অর্থের মধ্যে প্রথম ধাপেই ব্যায় করতে হবে ৩০ কোটি ডলার। এর অধিকাংশই যাবে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসুরক্ষার পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ ও বিতরণে। তবে প্রতিবেদনে এ আশঙ্কাও করা হয়েছে, করোনা মহামারির এই সময়ে বিশ্বব্যপী স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রীর যে চাহিদা, তাতে প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা সরঞ্জাম পাওয়া না-ও যেতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রীর একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে—
নজরদারি ও রোগ নির্ণয়: অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনের মধ্যে সবচেয়ে আগে রয়েছে নজরদারি ও রোগ নির্ণয়ে ল্যবরেটরি সরঞ্জামের কথা। পর্যাপ্ত কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ কিট এবং দ্রুত পরীক্ষা করার সক্ষমতাসম্পন্ন রোগ নির্ণয়কেন্দ্র নিশ্চিত করতে হবে প্রথমেই। দ্রুত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের কর্মীদের আরও দক্ষ করে গড়ে তোলার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। একইসঙ্গে কর্মীদের জৈব-সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা সামগ্রীর পর্যাপ্ততার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
শনাক্তকরণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা: কোভিড-১৯ সংক্রমণ এড়াতে রোগী শনাক্তকরণের পাশাপাশি দেশের প্রবেশপথগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সব প্রবেশপথে পর্যাপ্ত স্ক্রিনিং নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত স্ক্রিনিং ছাড়া যারা দেশে এরই মধ্যে ঢুকেছেন, তাদের শনাক্ত করতে প্রয়োজনে মোবাইল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা কাজে লাগাতে হবে।
সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও রোগ নিয়ন্ত্রণে সব জেলার স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের দ্রুত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। করোনার সংক্রমণ রোধ এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সামনের সারির সৈনিক চিকিৎসকদের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি গুরুতর হলে পর্যাপ্তসংখ্যক নিবিড় পরিচর্যাকরণ ব্যবস্থা (আইসিইউ) তৈরি রাখার কথা বলা হয়েছে। চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্য, মনোবল রক্ষায় প্রণাদনামূলক প্রচারণা এবং সংক্রমণ রোধে কোয়ারেনটাইনে (জনবিচ্ছিন্ন) ও পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় প্রচারণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
দুর্যোগকালীন যোগাযোগ এবং জনগণের সংযুক্তি: বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত করোনা মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাস এবং বিবেচনাবোধকে কাজে লাগিয়ে এবং জনগণের অংশগ্রহণে একটি কার্যকর মডেল তৈরির ওপর গুরত্ব দেওয়া হয়েছে এতে। মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি ও গণমাধ্যমে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সংকটময় এই সময়ে গুজব মোকাবিলায় সঠিক তথ্য প্রচার এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি প্রশাসনিক কেন্দ্র থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
দুর্যোগের এই সময়ে জাতীয় হটলাইনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। যাতে এর মাধ্যমে দ্রুত জরুরি স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সেবা দেওয়া সহজ হয়। এইজন্য হটলাইনের অবকাঠামো, সার্ভার, অ্যপ্লিকেশন এবং ওয়েব ম্যানেজমেন্ট, কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী পরিচালনা, সেবাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগসহ অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোকে শক্তিশালী করতে বলা হয়েছে, যেন সবচেয়ে দ্রুত সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। একইসঙ্গে কর্মীদের উৎসাহ এবং প্রশংসার মাধ্যমে মনোবল চাঙ্গা রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় হাত ধোওয়া এবং পরিচ্ছন্ন থাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসম্পৃক্ততা ও সচেতনতার জন্য সারাদেশে সাত হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ব্র্যাকসহ অন্যান্য সহযোগী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত হাত ধোয়ার বেসিন বা বিকল্প উপায়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সচেতনতা বাড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকেও গুরুত্বসহ প্রচারের ব্যবস্থার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিকবেদনে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা ও বিতরণ: প্রতিবেদনের শেষ ভাগে রয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা ও বিতরণের বিষয়ে বিশদ গাইডলাইন। প্রতিবেদন অনুসারে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতি দ্রুত রোগ পরীক্ষার সরঞ্জামাদি ও প্রয়োজনীয়সংখ্যক কিটের সংস্থান প্রয়োজন। এছাড়া চিকিৎসকসহ করোন যুদ্ধের সৈনিকদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম, সার্জিক্যাল মাস্ক, এন৯৫ মাস্ক, চোখ সুরক্ষার ও জীবানুনাশক সরঞ্জাম কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে জেলা শহরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক সরঞ্জাম দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে জাতিসংঘের এই সমন্বিত প্রতিবেদনে।
করোনা পরিস্থিতি করোনাভাইরাস জাতিসংঘ জাতিসংঘের প্রতিবেদন বাংলাদেশ পরিস্থিতি বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি: প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সন্দীপন বসু