করোনায় ১ লাখ কোটি টাকার ধাক্কার মুখে অর্থনীতি
১ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৫৯
ঢাকা: করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, করোনাভাইরাসে পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষতির পরিমাণ তাদের মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে এই ক্ষতির পরিমাণ যদি জিডিপি‘র ৫ শতাংশও হয়, তাহলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ কোটি টাকা। এই ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখতে চাইলে এবং আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হলে সরকার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিবাজারগুলোতে জানুয়ারি থেকে মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে ২৬ ভাগ পর্যন্ত দরপতন হয়েছে। এই সময়ে চীনের শিল্পোৎপাদন কমেছে ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেশ বড় ধরনের দরপাতন হয়েছিল সোনার দামেও। শেষ পর্যন্ত সেই ধাক্কা সোনা কাটিয়ে উঠলেও তেলের দাম নেমে গেছে ১৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্য বলছে, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানিসহ বিশ্বের সব দেশেই করোনাভাইরাসের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এ বছর কমবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
বাংলাদেশে এর ক্ষতি কতটা হতে পারে— জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে। আমাদের যদি তার অর্ধেকও হয়, তাহলেওও ১ লাখ কোটি টাকা বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে।
পিআরআই‘র এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, সার্বিকভাবে করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভার পড়বে। কারণ দেশ দীর্ঘ মেয়াদে ছুটিতে যাচ্ছে। এতে করে উৎপাদন হচ্ছে না। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে হবে। এটা কে দেবে? তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাকা খাটছে, এই টাকার বিপরীতে সুদ উঠছে, এই সুদ তো কেউ মওকুফ করছে না। পরবর্তী সময়ে উদোক্তারা কিভাবে টাকা পরিশোধ করবেন? তাদের টার্নওভার থাকলেও ধীরে ধীরে বিনিয়োগের টাকা উঠে আসত। কিন্তু এখন কোনো টার্নওভার নেই। ফলে এর ঋণাত্নক প্রভাবটা খুব বড় হবে। আর এটা এককভাবে উদোক্তাদের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে রাতারাতি তারা ঋণখেলাপি হয়ে পড়বে। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি আমাদের কাম্য হতে পারে না।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার প্রভাবে কুটির শিল্পের লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে যাবে। তাদের কী হবে— সেই চিন্তা সরকারকে করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশের সরকারকেই তাই করতে হয়। তবে ব্যক্তি খাত বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারে। তবে যেহেতু ব্যক্তি খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই।
এ ক্ষেত্রে সরকারের কী করণীয়— সে প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনা পরবর্তী অর্থনীতি মোকাবিলায় পৃথিবীর অনান্য দেশ যা করছে, আমাদেরও তাই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রফতানিমুখী খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এটি ভালো দিক। অনান্য খাতেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিশেষ করে এসএমই খাতটি অনেক বড় খাত। এই খাতে নিয়োজিত জনবল অনেক বেশি। আরও রয়েছে পর্যটন শিল্প, হোটেল-রেস্টুরেন্ট। এগুলোও সবই বন্ধ। এদের জন্যও সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে সব খাতকেই বিভিন্নভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। বিভিন্ন খাতে যে ক্ষতিটা হচ্ছে, তার একটি বড় অংশ মিটিয়ে দেওয়া উচিত। সেটা ব্যাংকের ঋণ মওকুফ করেই হোক অথবা শ্রমিকদের বেতন দিয়েই হোক। দুইয়ের সমন্বয়েও সেটা করতে পারে সরকার। সেটা করা গেলেই করোনার ধাক্কা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, আমাদের দুইটি জিনিস ঠিক রাখতে হবে— একটি অভ্যন্তরীণ চাহিদা, অন্যটি বৈদেশিক চাহিদা। তিনি বলেন, বৈদেশিক চাহিদা তো এককভাবে আমরা ঠিক করতে পারব না। এটা নির্ভর করবে বাইরের সিচুয়েশনের ওপর। সেটা ওকে হলে আস্তে আস্তে অর্ডার চলে আসবে। তবে আমাদের দিক থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদার কিন্তু বড় পতন হয়েছে। সেটা মাথায় রাখতে হবে।
করেনাভাইরাসের প্রভাবে রফতানি আয়ের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ রেমিট্যান্সসহ আরও বেশকিছু খাত বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে রফতানির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। করোনা সংকটের আগে থেকেই রফতানি প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এখন এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এরই মধ্যে অনেক দেশ ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল করতে শুরু করেছে।
রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ আসবে প্রবাসী আয়ে। প্রবাসী আয়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ২১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এই সংকটে প্রবাসী আয়ও অনেক কমে যাবে। পৃথিবীর অনক দেশে আমাদের শ্রমিকেরা কাজ করছেন। সেসব দেশে বেতন কমে যাবে, অনেকে চাকরি হারাবেন। ফলে এইসব শ্রমিকরা দেশে ফিরলে অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়বে।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, বৈদেশিক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় বিমানের আয় কমে যাবে, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারী এবং কল-কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকেরা চাকরি হারাবেন। এতে বেকারত্ব বাড়বে। নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমানের আরও অবনতি ঘটবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় সরকারের রাজস্ব আহরণও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কমে যাবে। সার্বিকভাবে এসব বিষয় দেশের অর্থনীতিতে বড় সংকট তৈরি করবে।
অর্থনীতির এই চিত্র সরকারের জন্য নানা দিক থেকে চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন সাবেক এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, করোনা সংকটে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারের সহায়তা বাড়াতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করের হার কমাতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে কর মওকুফ করতে হবে। এতে করে ব্যয় বাড়লেও সরকারের আয় কমবে। ফলে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে। সব দিক দিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
‘কঠিন’ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের করণীয় তুলে ধরে মির্জ্জা আজিজ বলেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে আমাদের মঞ্জুরি সহায়তা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এসব সংস্থাগুলো ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহী থাকে। ফলে মঞ্জুরি সহায়তা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে সফট লোন বা সহজ ঋণের জন্য দর-কষাকষি করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার দৃঢ় অবস্থান নিলে বাড়তি সুবিধা আদায় করা কঠিন হবে না। বিনিময়ে সুশাসন, বিনিয়োগ পরিবেশ, ব্যবসা সহজীকরণের শর্ত পূরণ করতে হবে।
দেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব কী— জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাইরাসের কারণে রফতানি খাত সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে। তার মধ্যেও আবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক খাত। কারণ এই খাতে আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা। এসব এলাকার অনেক দেশই ক্রয়াদেশ বাতিল করছে, স্থগিত করছে। আমাদের দেশে এখনো বিস্তৃত আকারে না ছড়ালেও করোনাভাইরাস যেভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে এবং ছড়াচ্ছে, তাতে আমরা আতঙ্কিত।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মো. আসিফ ইব্রাহিমও বলছেন, অর্থনীতির সব খাতই করোনাভাইরাসের কারণে টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। দেশের শিল্প-বাণিজ্য থেকে শুরু করে আমদানি-রফতানি, শেয়ারবাজার— সবই বিপর্যয়ের মুখে। প্রতিদিনই ব্যবসা-বাণিজ্যে ধ্বস নামছে। সব মিলিয়ে আমরা আতঙ্কিত।
১ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব অর্থনৈতিক ক্ষতি আহসান এইচ মনসুর এফবিসিসিআই করোনাভাইরাস ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ডিসিসিআই বিজিএমইএ