কোভিড-১৯: শিশুর চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরের বিকল্প ‘বাবল সিপিএপি’
২ এপ্রিল ২০২০ ১০:০৯
ঢাকা: নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় শ্যাম্পুর বোতল ব্যবহার করে উদ্ভাবিত দেশীয় ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’ গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনায় রয়েছে। দেশীয় চিকিৎসক ড. মো. যোবায়ের চিশতীর এই উদ্ভাবন শিশুদের জন্য স্বল্পমূল্যে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মেনে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় অক্সিজেন সরবরাহ করেও শিশু মৃত্যুর হার যেখানে ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি, সেখানে ড. চিশতীর এই পদ্ধতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই মানের চেয়েও ৭৫ শতাংশ বেশি শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিলে এই ‘বাবল সিপিএপি পদ্ধতি’ প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছে ডব্লিউএইচও। শুধু তাই নয়, বয়স্কদের ক্ষেত্রেও পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা যায় কি না, তা নিয়েও চলছে গবেষণা।
এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি হাসপাতালে দেশীয় এই পদ্ধতিটির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইথিওপিয়ার দু’টি হাসপাতাল। দেশের দু’টি হাসপাতাল ছাড়াও নেপালেও শিগগিরই পদ্ধতিটির প্রয়োগ হবে।
আইসিডিডিআর,বি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ বিভাগের প্রধান ড. চিশতী সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে বাবল সিপিএপি পদ্ধতি তো চলছেই। এর বাইরে দেশের দু’টি হাসপাতালে পদ্ধতিটি ব্যবহারের প্রক্রিয়া চলছে। কুড়িগ্রাম ও নরসিংদীতে এ মাসেই শুরু হওয়ার কথা ছিল। আশা করি করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এলে হাসপাতাল দু’টিতে পদ্ধতিটি প্রয়োগ করে শিশুদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসা শুরু হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে এই গবেষক বলেন, ইথিওপিয়ার চারটি হাসপাতালে পদ্ধতিটি প্রয়োগে কাজ চলছে। এর মধ্যে দু’টি হাসপাতালে পদ্ধতিটি প্রয়োগ হচ্ছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ১২টি হাসপাতালে পদ্ধতিটি প্রয়োগ হওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইথিওপিয়ার পরে আমাদের টার্গেট নেপাল। নেপালের সরকারের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ইথিওপিয়ার কাজ শেষ হলেই নেপালে আমারা কাজ শুরু করতে পারব।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে অক্সিজেন সংকটে পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা যাবে কি না— জানতে চাইলে ড. চিশতী সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। পাঁচ বছরের নিচে কোনো শিশু করোনায় আক্রান্ত হলে তার মধ্যে নিউমোনিয়া বা অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিলে তার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্ভব। ভবিষ্যতে বয়স্কদের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি সমাধান বের করতে পারব বলে আশা করছি। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি এর আগে কখনো প্রয়োগ করা হয়নি। তবে করোনার জন্য কোনো শিশু যদি নিউমোনিয়া ও অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগে, সেক্ষেত্রে বাবল সিপিএপি পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), যা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের খবর।
বাবল সিপিএপি পদ্ধতি কী
মূলত শ্যাম্পুর বোতল ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এ পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. চিশতী বলেন, ‘প্রথমে শ্যাম্পুর বোতলে পানি ঢুকাই। বুদ্বুদ তৈরির মাধ্যমে বাবল সিপিএপি তৈরি করা হয়, যা খুবই সাধারণ প্রক্রিয়া। ভেন্টিলেটর পদ্ধতিতে দু’টি নল ঢুকানো হলেও বাবল সিপিএপি ডিভাইসের মাধ্যমে কেবল একটি নল ঢুকানো হয়। অন্য আরেকটি নল দিয়ে বুদ্বুদ বের হয়। এতে অক্সিজের খরচ যেমন কমে, তেমনি বেঁচে যায় হাজার হাজার শিশুর প্রাণ।’ দেশীয় চিকিৎসকের উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিটি সাশ্রয়ীও বটে।
কেন বাবল সিপিএপি পদ্ধতি
ড. চিশতী জানান, শিশুদের তীব্র নিউমোনিয়া হলে হাইপোক্সিয়া দেখা দেয়। রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে এটি হয়। তীব্র নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। একসময় অক্সিজেনকে সাপোর্টিং থেরাপি মনে করা হলেও বর্তমানে এটি ড্রাগ হিসেবে সমাদৃত। আর নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ড মেনে শিশুকে অক্সিজেন দেওয়া হলেও মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ।
ড. চিশতী বলেন, যেহেতু আমাদের মতো হাসপাতালে ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ড মানার পরও শিশু মারা যাচ্ছে, তাহলে অন্যান্য হাসপাতালে হয়তো এই মৃত্যুর হার আরও অনেক বেশি। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এর চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরের দাম ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার। সবাই ভেন্টিলেটর চালাতেও পারেন না। এ জন্য প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্স দরকার। কম খরচে কিভাবে এ চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেই ভাবনা থেকেই এ পদ্ধতি উদ্ভাবন।
এই গবেষক আরও বলেন, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে কাজ করার সময় একটি বুদ্বুদ তৈরির সিপিএপি যন্ত্র দেখেছিলাম। সেটির কথা মনে পড়ে। তখন হাতের কাছে একটি শ্যাম্পুর বোতল ছিল। বোতলে পানি ঢুকালাম। বুদ্বুদ তৈরির মাধ্যমে বাবল সিপিএপি তৈরি করা হলো। এটা খুবই সাধারণ প্রক্রিয়া। শিক্ষকরা পরে এটিকেই আমার গবেষণার বিষয় নির্ধারণ করে দেন। পিএইচডিতে আমাকে এর ওপরই গবেষণা করতে হয়েছে।
ড. চিশতীর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায়। জন্ম ১৯৬৯ সালে। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে। পরে মেলর্বোনে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসেন ঢাকায়। অস্ট্রেলিয়ায় তার সুপারভাইজার ছিলেন প্রফেসর ট্রেভর ডিউক। চিশতীকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করছেন তিনি।
সিপিএপি বাবল নিয়ে ড. চিশতীর গবেষণার ফল প্রকাশ পায় বিশ্বের প্রভাবশালী চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে। ২০১৫ সালে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসে সিপিএপি বাবল পদ্ধতি বেস্ট চাইল্ডহোড নিউমোনিয়া ইনোভেশন হিসেবেও স্বীকৃতি পায়। তার এই পদ্ধতি এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।