করোনা: এসএমই ও কুটির শিল্পে ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা
২ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৩৮
ঢাকা: দেশের অর্থনীতির বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ও কুটির শিল্প খাত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, এই খাতে নিয়োজিত দেশের প্রায় ৭৮ লাখ মানুষ। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের সব বিপণী বিতানসহ সব ধরনের মেলা আয়োজন বন্ধ থাকায় এই খাতের অবস্থা নাজুক। পাশাপাশি এ বছর পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়ায় গোটা এসএমই ও কুটির শিল্প খাত রয়েছে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত সময় ধরেই এই খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা। আর করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটিসহ দোকানপাট বন্ধ রাখার সময়কাল ঈদুল ফিতর পর্যন্ত বাড়লে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে বড় অঙ্কের প্রণোদনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, এসএমই ও কুটির শিল্প খাতে করোনার প্রভাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প সচিব। গত ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় স্থান পায় এসএমই ও শিল্প খাতও। এই খাত টিকিয়ে রাখতে তৈরি পোশাক খাতের মতো বড় ধরনের প্রণোদনাও চাওয়া হয় বৈঠকে। শিল্প সচিব মো. আবদুল হালিম বৈঠকটির তথ্য সারাবাংলাকে নিশ্চিত করলেও বৈঠকের আলোচ্য বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পহেলা বৈশাখ এই খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য বড় একটি উপলক্ষ। বছর ধরে তারা এরকম কয়েকটি উপলক্ষের অপেক্ষাতেই থাকেন। ফলে এ বছর পহেলা বৈশাখের কোনো আয়োজনসহ সব ধরনের মেলা স্থগিতের কারণে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন।
আরও পড়ুন- করোনায় ১ লাখ কোটি টাকার ধাক্কার মুখে অর্থনীতি
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, পহেলা বৈশাখের সব আয়োজন স্থগিত হওয়ায় পহেলা বৈশাখ-কেন্দ্রিক কোনো বিপণন হবে না। এতে এই খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নামবে। দ্বিতীয়ত, ফ্যাশন খাতের ১২ মাসের ব্যবসার মূল ব্যবসাটাই হয় পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের সময়। এই দুই উপলক্ষে যে ব্যবসা, তা বছরের বাকি সময়ের চেয়েও বেশি।
তিনি বলেন, বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা টার্নওভার হয় এসএমই খাত থেকে। এর মধ্যে শুধু পহেলা বৈশাখ আর ঈদুল ফিতরের সময় টার্নওভার হয় এর প্রায় অর্ধেক। সেই হিসাবে এই খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা।
শফিকুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে চলমান অবস্থা যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে, এই খাতের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তত বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। আগামী তিন মাসে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান, প্রোডাকশন প্ল্যান ও সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে সরকারকে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে হবে। পাশাপাশি প্রোডাকশন প্ল্যানকে সাপোর্ট দিতে হবে, যেন সঠিক প্রোডাকশন হয়। সেজন্য ব্যাংক ঋণসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে করোনার কারণে সংকুচিত বাজার যেন প্রসারিত হতে পারে, সেজন্য নাগরিকদেরও সহায়তা করতে হবে। প্রয়োজনে নাগরিকদের বিদেশি পণ্যার পরিবর্তে দেশি পণ্য বেশি করে কিনতে হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) চেয়ারম্যান মোস্তাক হাসান সারাবাংলকে বলেন, করোনার কারণে বিসিক শিল্প নগরীতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। আমাদের শিল্প নগরীতে অনেকগুলো রফতানিমুখী গার্মেন্টস রয়েছে। করোনার কারণে এরই মধ্যে গার্মেন্টসগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশি অর্ডার স্থগিত কিংবা বাতিল হচ্ছে। আবার দেশের বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকে, সেই চাহিদাও এখন নেই। সব মিলিয়ে আমরা আতঙ্কিত।
আরও পড়ুন- পোশাক খাতে সুখবর: ক্রয়াদেশ বহাল রাখছে ক্রেতারা
তিনি বলেন, আমাদের অনেকগুলো মাইক্রো এন্টারপ্রেনার রয়েছেন, যারা সারাবছর মেলা করে নকশী কাঁথা, বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, বিছানার চাদর, ঘর সাজানোর নানা ধরনের উপকরণ, খেলনাসহ তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি করেন। বর্তমানে মেলা বন্ধ থাকায় তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। আবার পহেলা বৈশাখকে ঘিরে তাদের বড় ধরনের পরিকল্পনা থাকে, সেগুলোও স্থগিত। ফলে তারা বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বিসিক চেয়ারম্যান আরও বলেন, করোনায় কুটির শিল্প কী ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তার একটা প্রাথমিক হিসাব করা হচ্ছে। সেটা শেষ হলে ক্ষতির পরিমাণ বলা যাবে। তবে এই খাত ঠিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছে প্রাণোদনা চাওয়া হবে।
অন্যদিকে জাতীয় ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সমিতির সভাপতি মির্জা নূরুল গণি শোভন সারাবাংলাকে বলেন, করোনার কারণে সারাদেশে সবকিছু যে বন্ধ থাকছে, এতে করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রতি মাসে খরচ হবে। কারণ দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কুটির শিল্প ছাড়াও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত রয়েছে। যারা ছোট ব্যবসায়ী, যেমন— বিউটি পার্লার, সেলুন, লন্ড্রি, বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, কাটিং হাউজ— এ ধরনের কয়েক লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিতদের যদি একমাসও বেকার থেকে পুঁজি ভেঙে খেতে হয়, তাহলে মাসে খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
মির্জা নূরুল গণি বলেন, বর্তমানে সব বিপণী বিতান বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি আগামী পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। এই দুইটি কারণে এই খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা।
এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনার দাবি জানান মির্জা নূরুল গণিও। তিনি বলেন, এই অবস্থা থেকে দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে রক্ষা করতে হলে বড় ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। তা না হলে এসব ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্মকরত শ্রমিক ও উদ্যেক্তারা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বেন।
আর্থিক ক্ষতি ঈদুল ফিতর এসএমই খাত করোনাভাইরাস করোনাভাইরাসের প্রভাব কুটির শিল্প কোভিড-১৯ পহেলা বৈশাখ