দুর্গম পাহাড়ে ‘হামে’র হানা, ১০ শিশুর মৃত্যু
৩ এপ্রিল ২০২০ ১৭:১৭
রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার দুর্গম সাজেক ইউনিয়নে হাম ও হামসদৃশ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই। জেলার সবচেয়ে বড় ও দুর্গম এই ইউনিয়নের ১০ থেকে ১২টি গ্রামে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই শতাধিক। ২৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে এ পর্যন্ত এ রোগে ১০টি শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু সাজেকেই মৃত্যু হয়েছে আট শিশুর। চিকিৎসকের পরিবর্তে স্থানীয় বৈদ্যদের পরামর্শে চিকিৎসা নেওয়াকে এর পেছনে বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া শিশুদের অপুষ্টি এবং স্থানীয়দের মধ্যে টিকা নিয়ে ভীতিকেও এর পেছনে কারণ মনে করা হচ্ছে।
সাজেকের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাজেক ইউনিয়নের তুইচুই মৌজার দুর্গম অরুণপাড়ার শিশুরা হামের মতো এক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। প্রথমে স্বাস্থ্যবিভাগ রোগটিকে ‘অজ্ঞাত রোগ’ বললেও পরে ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করায় এতে হাম বলে নিশ্চিত করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে অন্য শিশুদের মধ্যেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। তবে এর উপসর্গ হামের মতো হলেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অরুণপাড়ায় সাগরিকা ত্রিপুরা (১৩) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। পরে সাজেকের অরুণপাড়াসহ লংতিয়ান পাড়া, কমলাপুর পাড়া, হাইচ্চাপাড়া ও তারুমপাড়ায় পাড়ায় আরও ১৩৬ জন শিশু একই রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে এ পর্যন্ত অরুণপাড়ায় পাঁচ শিশু ও লংতিয়ান পাড়ায় দুই শিশুর মৃত্যু হয় এ রোগে। সবশেষ গত ৩০ মার্চ দিবাগত রাতে সাজেকের ব্যাটালিং মৌজার উদোলছড়ি গ্রামে সুরেশ কুমার ছেলে নিকেতন চাকমা (১৫) নামে আরও এক শিশু মারা যায়। এর আগে পার্বত্য খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এক ত্রিপুরা শিশু ও বান্দরবানের লামায় এক ম্রো শিশুও মারা গেছে হামের মতো এই রোগে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্তমানে সাজেকের কয়েকটি মৌজার ১০-১২টি গ্রামের শিশুরা হামসদৃশ এই রোগে আক্রান্ত আছে। এ পর্যন্ত মারা গেছে আট শিশু। হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে আরও আট শিশুকে।
স্থানীয় কার্বারিরা (গ্রামপ্রধান) জানিয়েছেন, দুর্গম গ্রামের মানুষরা এখনো কুসংস্কারে বিশ্বাসী হওয়ায় চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা না করিয়ে শিশুদের স্থানীয় বৈদ্য, পূজা ও লতাগুল্মের মাধ্যমে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এতে করে শিশুরা আক্রান্তের সময় দীর্ঘ হওয়ায় সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। আবার অনেক অভিভাবক এক ধরনের ভীতির কারণে শিশুকে টিকা দেন না, এমনকি স্যালাইন পর্যন্ত খাওয়াতে চান না। ফলে এসব শিশুরা কোনো রোগে আক্রান্ত হলে তাদের সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
কার্বারিরা আরও বলছেন, দুর্গম সাজেকের একেকটি এলাকা থেকে একেকটি এলাকায় পৌঁছাতে দুই-তিন পর্যন্ত সময়ও লাগে। পাড়ি দিয়ে হয় গহীন অরণ্যও। এতে অল্প সময়ের মধ্যে মেডিকেল টিম সব এলাকায় পৌঁছাতে পারে না। তাছাড়া অধিকাংশ মানুষ শিশুদের লতাপাতা ও বৈদ্যালি চিকিৎসা দেন।
সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা বলেন, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত ৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ উদলছড়ি গ্রামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এখনো সাজেকের উদোলছড়ি, নিউঢাংনাং, কমলাপুর, শিবপাড়া, সাতনাম্বার পাড়া, বড়ইতলী, ডেবাছড়ি, কজইছড়ি, ভূয়াছড়ি, লাম্বাবাক ও উজানছড়িতে বিচ্ছিন্নভাবে আড়াই শতাধিক শিশু হামসদৃশ রোগে আক্রান্ত আছে। এসব গ্রামে শিশুদের পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
ইউপি চেয়ারম্যান নেলশন জানান, গত বুধবার সাজেকের সাতনাম্বার পাড়া থেকে একই পরিবারের দুই শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের খাগড়াছড়ি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর আগে লংতিয়ান পাড়ার একই পরিবারের ভাই ও অরুণপাড়ার এক শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। যতটুকু জেনেছি, তারা সবাই সুস্থ আছে। বর্তমানে সেনাবাহিনী ও বিজিবির মেডিকেল টিম ছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগের দুইটি মেডিকেল টিমের একটি উদোলছড়ি ও আরেকটি মাচালং এলাকা থেকে ভূয়াছড়িসহ আশপাশের এলাকায় চিকিৎসা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, দুর্গম গ্রামের মানুষ হওয়ায় এসব এলাকার মানুষজন বেশিরভাই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। অনেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করে গ্রামে বৈদ্যের চিকিৎসা দিচ্ছেন। এর কারণেই শিশুরা সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
সম্প্রতি সাজেকের মাচালং ও সাতনাম্বার এলাকাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে হাম বা হামের মতো এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. বিষ্ণুপদ দেবনাথ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বেশ কয়েকটি এলাকায় হামের মতো রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে এসেছি। প্রত্যন্ত গ্রামের এসব মানুষের মধ্যে অনেক বেশি টিকাভীতি রয়েছে। এরা গুরুতর অসুস্থ শিশুদেরও স্যালাইন দিতে চান না। স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসার চেয়ে তারা স্থানীয় বৈদ্যের চিকিৎসায় আগ্রহী। ওইসব এলাকার শিশুরা অপুষ্টিতেই ভুগছে, বেশিরভাগ শিশুই খুব শুকনো।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইফতেখার আহমেদ জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে আনুমানিক ১৬০ জন শিশু এই রোগে আক্রান্ত। তিনি বলেন, আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম যে শিশুদের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছি, ল্যাবরেটরি রিপোর্টে তাদের হাম রোগ শনাক্ত হয়েছে। এটি সংক্রামক রোগ হওয়ায় একে আমরা হাম বলেই ধারণা করছি। তবে ১৬০ শিশু ছাড়াও অনেকেই শিশু নিউমোনিয়া ও সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রয়েছে। তাদের লক্ষণগুলোকে হাম বলা যাচ্ছে না। বর্তমানে সাজেকে আমাদের দুইটি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আহসান হাবিব জিতু বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত সাজেক ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে হামের মতো একটি রোগে ১৭৪টি শিশু আক্রান্ত হয়েছে। আমি গত মঙ্গলবার সাজেকের তিন গ্রাম সাতনাম্বার পাড়া, শিব পাড়া ও বড়ইতলী এলাকা পরিদর্শন করেছি। এদিন স্থানীয়দের মাঝে পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করছি। এছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিকেল টিমও কাজ করছে।
রাঙ্গামাটি জেলা সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত সাজেকের বিভিন্ন গ্রামের ১৭০ শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) সাজেকের শিয়ালদহ এলাকায় উদ্দেশ্যে আমাদের আরেকটি মেডিকেল টিম রওয়ানা দিয়েছে। তারা শুক্রবার সেখানে পৌঁছে কাজ শুরু করবে।
এদিকে, গত ২৮ মার্চ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের ত্রিপুরা অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রাম রথিচন্দ্র কার্বারি পাড়ায় হামসদৃশ রোগে আক্রান্ত হয়ে ধ্বনিকা ত্রিপুরা নামের ৯ বছরের এক শিশু মারা যায়। এ ঘটনার পর রথিচন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার আরও ২০ শিশুকে দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। তারা বর্তমানে সুস্থ আছে।
এছাড়া গত ১৩ মার্চ বান্দরবানের লামা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরাতন লাইল্যা মুরুং পাড়ায় হাম আক্রান্ত হয়ে দুতিয়া মুরুং (৭) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার ওই পাড়ার আক্রান্ত আরও ৩৫ শিশুকে ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। তারা সবাইও সুস্থ আছে।