বেড়েছে মশার উপদ্রব, মশক কর্মীরা ব্যস্ত করোনায়
৬ এপ্রিল ২০২০ ০৮:৩০
ঢাকা: ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা বেশ ভুগিয়েছে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষকে। গতবারের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবার বছরের শুরু থেকেই মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছিল বিভিন্ন সংস্থা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে কার্যত ভাটা পড়েছে। গত তিন মাসে মশা নিধনে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এতে ক্রমেই বাড়ছে মশার উপদ্রব। মশা বিড়ম্বনায় এখন নাকাল নগরবাসী। যদিও দুই সিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, মশক নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসে দুই সিটি নির্বাচনের কারণে অনেকটা গা-ছাড়া ভাব ছিল মশক নিধন কর্মীদের মাঝে। নির্বাচন শেষে ফেব্রুয়ারিতে মশক নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছিল দুই সিটি। সেটিও সপ্তাহখানের ব্যবধানে ঝিমিয়ে পড়ে। এরপর মার্চে শুরু হয় করোনা আতঙ্ক। তাই করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মশক নিধন কর্মীদেরকে নিয়োজিত করা হয়েছে জীবাণুনাশক স্প্রে করার কাজে। এতে আগে থেকেই ঝিমিয়ে পড়া মশক নিধন কার্যক্রমে যেন পুরো ভাটা চলছে।
রাজধানীর হাজারীবাগ, বংশাল, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, মগবাজার, মিরপুর, উত্তরা ও নতুনবাজার এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা অভিযোগের সুরে সারাবাংলাকে বলেন, গত বছর ডেঙ্গুর উপদ্রবের পর দুই সিটি যেভাবে মশা নিধনে মাঠে ছিল, গত তিন মাসে সেভাবে কার্যকম দেখা যায়নি। এসব এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, মশার উপদ্রবে রাত তো দূরের কথা দিনেও মশারি ছাড়া ঘুমানো যায় না। বাসাবাড়িতে মশা নিয়ন্ত্রণে কয়েল এবং অ্যারোসলেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
এমন অভিযোগ শুধু নগরবাসীর নয়, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিরক্ত প্রকাশ করেছেন মশার উপদ্রব নিয়ে। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) গণভবনে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে করোনা মোকাবিলায় দিক নির্দেশনা দেওয়ার সময় মশার উপদ্রব ঠেকাতেও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এ সময় তাকে রাজধানীতে মশার উপদ্রব নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে মন্তব্য করতেও দেখা গেছে।
রাজধানীর হাজারীবাগের বাসিন্দা রশিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে তো অফিসে যেতাম। সেজন্য মনে করতাম, রাতের বেলায় মশার উপদ্রব বাড়ে। কিন্তু এখন তো করোনা আতঙ্কে বাসায় থাকি। তাই বুঝতে পারছি মশার উৎপাতে দিন-রাতের কোনো পার্থক্য নেই।’
নতুন বাজারের বাসিন্দা তাজুল ইসলাম পাভেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে শুধু রাতের বেলায় মশারি টাঙাতাম। এখন আর খুলিই না। বাসায় যখন থাকি, দিন-রাত মশারির ভেতরেই থাকি।’ তিনি বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন, ‘এ বছর মশার ওষুধ ছিটানো তো দূরের কথা, মশক কর্মীদেরই দেখা যায়নি।’
একই কথা বললেন মিরপুরের পল্লবীর বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। তবে তিনি কিছুটা উপহাসের সুরে বলেন, ‘আমাদের তো অভ্যাস হয়েই গেছে। সমস্যা হওয়ার পর রোগের চিকিৎসা করা। তাই রোগ না আসলে চিকিৎসার কি দরকার?’
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটিতে বর্তমানে মশক নিধন কর্মী আছেন ৩২০ জন। সেইসঙ্গে আউটসোর্সিংয়ের (চুক্তিভিত্তিক) কর্মী ৫৪০ জন। সর্বমোট ৮৬০ জন। সংস্থাটির ৫৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে পাঁচজন মূলকর্মী ও আউটসোর্সিংয়ের ১০জনসহ মোট ১৫ জন প্রতিদিন সকাল-বিকাল লার্ভিসাইড ও ফগিং করার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সঠিক তদারকির অভাবে তারাও ঠিক মতো কাজ করছে না। আবার বিকল্প কর্মী না থাকায় বর্তমানে এসব কর্মীদের দিয়েই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে জীবানুনাশক স্প্রে করানো হচ্ছে। যদিও সংস্থাটির দাবি, করোনায় ব্যস্ত থাকলেও তারা এর পাশাপাশি মশন নিধনের কাজ করে যাচ্ছে।
মশক কর্মীরা অনেকেই নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করে না বলে স্বীকার করেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. মোমিনুর রহমান মামুন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের চাহিদার তুলনায় জনবল অপ্রতুল। কিন্তু যারা বা যে কয়েকজন আছে তারাও যদি নিজেদের দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতো তাহলেও মশার উপদ্রব থাকতো না। তাই আমি মনে করি, নজরদারির অভাবে অনেকেই কাজটি ঠিকমতো করতে চায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজকেও আমি উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় নিজে উপস্থিত থেকেই তদারকি করে ওষুধ ছিটাচ্ছি। কিন্তু আমার এলাকার ৫৪টি ওয়ার্ডে তো আমি নিজে একযোগে উপস্থিত থেকে তদারকি করতে পারব না। যদি না স্থানীয় কাউন্সিলর এবং মশক কর্মীরা নিজে থেকে কাজের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংকট যাই থাকুক, পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। যে ওষুধ নিরবচ্ছিন্নভাবে আগামী পাঁচ মাস ব্যবহার করা যাবে।
এদিকে ডিএসসিসি সূত্র জানা গেছে, সংস্থাটিতে মোট মশক নিধন কর্মী রয়েছেন ৪২৪ জন। যারা ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৫ জন করে সকাল-বিকাল দুবেলা লার্ভিসাইড ও ফগিংয়ের কাজ করেন। যদিও সংস্থাটিতে আউটসোর্সিংয়ের জনবল নেই। কিন্তু এখানেও অভিযোগ রয়েছে, জনবলের সংকট থাকলেও যারা রয়েছেন তারাও ঠিক মত কাজ করছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বি. জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কর্মীরা যে একেবারেই শতভাগ দায়িত্ব পালন করছে তা বলা যাবে না। আবার একেববারেই কাজ করে না তাও নয়। আমাদের মশক নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আমরা ফেব্রুয়ারি মাসেও ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে কার্যক্রম চালিয়েছি। তবে বিকল্প কর্মী না থাকায় করোনাভাইরাসের কারণে কর্মীরা এখন জীবণুনাশক স্প্রের কাজে ব্যস্ত। তবুও আমরা চেষ্টা করছি যাতে সকাল বেলা মশার লার্ভিসাইড করার পর জীবাণুনাশক ওষুধ স্প্রে করা যায়। এতে দুটো কাজই অব্যাহত থাকবে। যদিও এ কারণে কর্মীদের ওপর কাজের চাপ বাড়বে। কিন্তু আপাতত আমরা এভাবে চালিয়ে যাব।’
‘এ বছর মশা নিধনে কার্যকরী কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?’- জানতে চাইলে ডিএনসিসির সদ্য নির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কোনোভাবেই যেন মশার উপদ্রব না হয়। এ জন্য যা যা করা দরকার আমরা সব করছি। এরই মধ্যে আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে একটি কমিটি গঠন করেছি। এ কমিটির মাধ্যমে পুরো ডিএনসিসি এলাকা মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘মার্চের মাঝামাঝিতে করোনা ভাইরাসের কারণে কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। কারণ ওই সময় মশক কর্মী দিয়েই আমরা জীবণুনাশক স্প্রে করেছি। এখন মনে করছি, তার আর তেমন প্রয়োজন নেই, যতটা প্রয়োজন মশা নিয়ন্ত্রণ। তাই জীবণুনাশক স্প্রের কাজে নিযুক্ত কর্মীদের ফের মশার ওষুধ ছিটানোর কাজে নিযুক্ত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দিক নির্দেশনা দিতে শিগগিরই বৈঠকে বসা হবে।’
মশা নিধন নিয়ে ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতির পর আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী একটি পরিকল্পনা করেছিলাম। পরিকল্পনায় মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা একটি প্রকল্প গত বছর মন্ত্রণালয়ে সাবমিট করেছিলাম। কিন্তু গত পাঁচ মাসেও সেটির কোনো অগ্রগতি নেই। এছাড়া প্রায় এক হাজার মশক নিধন কর্মীর ইন্টারভিউ নিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ হচ্ছে না। তাহলে কাজটা করব কীভাবে। আগে তো আমাকে কর্মী দিতে হবে। কর্মী ছাড়া যদি কাজ বাস্তবায়ন করতে বলে সেটি কি সম্ভব? তবুও আমরা যে কয়জন কর্মী আছে তাদের দিয়ে মশক নিধন কাজ অব্যাহত রেখেছি।