করোনায় থমকে গেছে পাপিয়ার রাজত্বের খবর
১১ এপ্রিল ২০২০ ০৮:৩১
ঢাকা: যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীর রাম রাজত্বের খুঁটিনাটি বের করার দায়িত্ব পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব)। ওই দুজনসহ মোট চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিশেষ এই বাহিনীকে জন্য ১৫ দিন সময় দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে জিজ্ঞাসাবাদের পাঁচদিনের মাথায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবকিছু থামিয়ে দেয়। সবকিছু বন্ধ করে পাপিয়াসহ তার আরেক সহকারী পাঠানো হয় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। আর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে তার স্বামীসহ আরেক সহযোগীকে।
শুক্রবার (২৯ মার্চ) বিকেলে র্যাব-১’র আইনবিষয়ক কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (এএএপি) নাজমুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির পর পাপিয়াসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব-১-এ নেওয়া হয়েছিল। পাঁচদিন তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। পরে আদালতের নির্দেশে ১৫ মার্চ তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আদালতের নির্দেশে ফের পাপিয়াসহ চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
পাঁচদিনের জিজ্ঞাসাবাদে কোনো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে কি-না?- জানতে চাইলে নাজমুল হক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’
পাপিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১ এর সিও (কমান্ডিং অফিসার) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘পাঁচদিনের জিজ্ঞাসাবাদে আমরা কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাইয়ে পূর্ণ জিজ্ঞাসাবাদ দরকার এবং সেই অনুযায়ী ওয়ান টু ওয়ান জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো পরবর্তী সময়ে আদালতে জমা দেওয়া হবে।
এদিকে র্যব সূত্রে জানা গেছে, পাপিয়ার আন্ডারওয়ার্ল্ড সম্পর্কে যখন থানা ও ডিবি পুলিশ কিছুই বের করতে পারছিলেন না, ঠিক তখনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র্যাবকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়। কয়েকদিনের জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও বেরিয়ে আসে। করোনার কারণে সবকিছু থেমে আছে। তবে পাপিয়া কার কার সঙ্গে ব্লাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তার পুরো হিস্ট্রি র্যাবের কাছে বলেছে সে। এছাড়া কোথায় কীভাবে সম্পদ করেছেন এবং হাতিয়ে নেওয়া টাকাগুলো আর কোথায় কোথায় রেখেছে তাও বলেছে পাপিয়া। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে কোন কোন দেশে সে টাকা পাচার করেছে সেসব তথ্যও দিতে শুরু করেছিল এই আন্ডারওয়ার্ল্ড কুইন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে পাপিয়াসহ চার আসামিকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করবে র্যাব। এরপর তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
সূত্র আরও জানায়, করোনা পরিস্থিতির কারণে পাপিয়ার রাম রাজত্বের অনুসন্ধান থেমে আছে। এই সময়টাতে মানুষ অন্য সবকিছু ভুলে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উম্মাতাল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পাপিয়ার অপকর্মের দুনিয়া ফের খুলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এর আগে ৯ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাপিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় র্যাবকে তদন্তের অনুমতি দেয়। ১০ মার্চ পাপিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সব ধরণের নথিপত্র র্যাবকে বুঝিয়ে দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর গত ২১ মার্চ সিআইডির (অর্গানাইসড ক্রাইম) পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বাদী হয়ে গুলশান থানায় অর্থপাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-২৮।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ওয়েস্টিন হোটেলের ২২০১ নম্বর কক্ষে বসে শামীমা নুর পাপিয়া ও তার সহযোগীরা মিলে গত বছরের ১০ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবৈধ মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছে। এ সময় তারা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ৫ কোটি ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৭৬১ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে সত্যতা পেয়েছে সিআইডি।
সিআইডি অনুসন্ধানে জানতে পারে, হাতিয়ে নেওয়া টাকার মধ্যে তেজগাঁও এফডিসি গেটের কাছে কার এক্সচেঞ্জ নামে গাড়ির শোরুমে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যোবায়ের আলম নামে একজনের নামে। সেই টাকার মধ্যে আরও ২০ লাখ টাকা নরসিংদীতে কেএমসি কার ওয়াশ অটো সলিউশনস নামে দোকানে বিনিয়োগ করে। এছাড়া পাপিয়া চার মাসে ওয়েস্টিন হোটেলে মোট ২৬টি কক্ষ ব্যবহার করেছেন যার মোট বিল পরিশোধ করেন ৩ কোটি ২৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৬১ টাকা। এছাড়া ফার্মগেটের দুটি বাসার মধ্যে একটি বাসা ভাড়া ছিল, যার প্রতিমাসে বিল আসতো ৫০ হাজার টাকা। সেই বিল বাবদ এক বছরে ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। পাপিয়া নিজের কাছে ৬০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা রেখেছিল। যার সবগুলো টাকাই র্যাব উদ্ধার করেছে।
পাপিয়ার সঙ্গে হোটেল ওয়েস্টিনের ম্যানেজার (বার) মো. বশির উদ্দিনের ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। সেইসঙ্গে যোবায়ের আলমও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানা গেছে। এজন্য সিআইডির করা মামলায় এদুজনকে ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় পাপিয়াসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সিআইডি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে।’
গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী এবং তাদের আরও দুই সহযোগীকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা, ইয়াবা, মদ ও জাল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। এরপর তাদের নিয়ে পাপিয়ার নরসিংদী ও ফার্মগেটের বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ৫৮ লাখ টাকা, অবৈধ পিস্তল ও গুলি, বিদেশি মুদ্রা ও মদ উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় বিশেষ ক্ষমতা ও অস্ত্র আইনে দুটি এবং বিমানবন্দর থানায় মাদক, অর্থপাচার ও জাল মুদ্রা রাখার অভিযোগে একটি মামলা করে র্যাব। এসব মামলায় ওই চারজনের ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
সাধারণ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তিদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়ে থাকে। পুলিশ তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়াসহ যাবতীয় কাজ করে থাকে। কিন্তু বিশেষ কিছু মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে তদন্ত করে র্যাব। সংস্থাটি বলছে, রিমান্ডের আগে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়ার বিদেশে অর্থপাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্যাসিনো থেকে শুরু করে আরও অনেক অপরাধে জড়িয়ে থাকতে পারেন পাপিয়া। সে কারণেই মামলাটি তদন্ত করার অনুমতি চেয়েছিল র্যাব।