তথ্য লুকিয়ে করোনা রোগীর দাফন, ঝুঁকিতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান
১১ এপ্রিল ২০২০ ১৭:০৮
ঢাকা: পরিবার সদস্যরা করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া এক রোগীর তথ্য গোপন করে দাফন করায় ঝুঁকিতে পড়েছে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার পশ্চিম শিয়ালদী গ্রাম। ঢাকার হাসপাতাল থেকে লাশ চুরি করে পালিয়ে নিয়ে গ্রামে দাফন করার ব্যবস্থা নেয় স্বজনরা।
ওই গ্রামে মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়ানো হয়। শত শত লোকের সমাগমের মধ্যেই ওই রোগীর দাফন করা হয় করবস্থানে।
মৃত আব্দুল্লাহ আল ফারুকী (৭০) সিরাজদীখান উপজেলার ইছাপুরা এলাকার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাদরাসার পরিচালক ছিলেন। মারা যাওয়ার পর তার নমুনা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হলে সেখানে তার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ওই জানাজায় যারা অংশ নিয়েছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তথ্য গোপন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে এভাবে দাফন করায় গোটা এলাকা এখন ঝুঁকিতে পড়েছে।
ওই মৃতদেহের গোসল যিনি করিয়েছিলেন তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঘটনার পর তার হদিস পেতে পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে।
শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল ফারুকী। হাসপাতালে ভর্তির আগে জরুরি বিভাগে জানানো হয় তার তলপেটে ব্যথা। তাই জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে পাঠান সার্জারি ইউনিটের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা সেখানে গিয়ে স্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখতে পান। এরপরেই তারা ইমার্জেন্সিতে জানান বিষয়টি এবং যোগাযোগ করা হয় আইইডিসিআরে। এরপরে তাকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান। মৃতদেহ কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তৃপক্ষ যখন লাশ দাফনের প্রটোকল মেনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন মুফতি আবদুল্লাহর পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীরা লাশ চুরি করে নিয়ে যান। একটি গাড়িযোগে তারা লাশ নিয়ে যান মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে। ঢাকা থেকে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন মানুষ নিয়ে তারা সেখানে লাশ দাফন করেন। এরপরে যে গাড়ি দিয়ে লাশ নিয়ে যান সেই গাড়ি দিয়েই আবার কিছু মানুষ ফেরত আসেন ঢাকায়।
বিভিন্ন বিশ্বস্ত সূত্রে এসব তথ্য উঠে আসে সারাবাংলার প্রতিবেদকের কাছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক সারাবাংলা বলেন, ‘৮ এপ্রিল সার্জারি ইউনিট-৫ এ একজন রোগী ভর্তি ছিলেন। আমরা নিচে রোগী দেখা শেষ করে উপরে যাই রাউন্ডে। সেখানে একজন রোগীকে পাই যার কেস হিস্ট্রিতে বলা হয়, পেটে ব্যথা ও পাঁচদিন পায়খানা হয়নি। ইমার্জেন্সি থেকেই তাকে ভর্তি দেওয়া হয়। আমরা তাকে পরীক্ষা করার সময় দেখতে পাই যে তিনি শুয়ে থাকতে পারছে না। আমাদের সন্দেহ হয় যে, তার শ্বাসকষ্ট আছে। আমরা তখন তাকে জিজ্ঞেস করি যে তার শ্বাসকষ্ট আগে থেকেই আছে কি না। তখন তারা বলেন যে না পায়খানা বন্ধ হওয়ার পর থেকেই শ্বাসকষ্ট আছে। তিনি যে আগে আসগর আলী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বা আগে কোথাও চিকিৎসা নিয়েছেন তা কিছুই বলেননি আমাদের।’
ওই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা তখন তাকে জিজ্ঞেস করি কোনো এক্স-রে হয়েছে কি না? তখন বলেন হ্যাঁ এক্স-রে করা আছে। এক্স-রে পরীক্ষার পর আমরা ইমার্জেন্সিতে ফোন করে জানাই। সেখানে বলি এই রোগীকে আইসোলেশনে নিতে হবে কারণ সিম্পটম সন্দেহজনক। তার পেটের এক্সরে দেখে বুঝি যে সেখানে কোনো সার্জিকাল ইমার্জেন্সি নেই। সে হিসেবে আমরা বলি যে, রোগীর কোনো সার্জিক্যাল সমস্যা নেই কিন্তু রেসপিরেটরি ইস্যু আছে।’
এরপরেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আইসোলেশনে। সেখানে এক্সরে দেখে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে অথবা বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানায় ঢামেক কর্তৃপক্ষ। এরপরেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কুর্মিটোলা হাসপাতালে।
কুর্মিটোলা হাসপাতালের বিশ্বস্ত সূত্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢামেক থেকে আসা রোগী হাসপাতালে আনার আগেই রাস্তাতে মারা যায়। কিন্তু সাসপেক্ট রোগী আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। কিছু প্রসেসিং থাকে যা আমাদের মানতে হয়। একই সঙ্গে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকেও স্যাম্পল নেওয়া হবে। তখন সেই মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আসা স্বজনরা স্বীকার করে যে আসগর আলী হাসপাতাল থেকে স্যাম্পল নেওয়া হয়েছে ও সেই স্যাম্পল আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে বলা হয় কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তা না করে তারা যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগ লুকিয়ে। কুর্মিটোলায় আমরা যখন লাশ প্রসেসিং করছিলাম দাফনের জন্য তখন মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা লাশ নিয়ে পালিয়ে চলে যায়। আমাদের এখানে ওদের নাম ঠিকানা যেটি ছিল সেখানে আমরা প্রশাসনকে ফোন করে জানাই। প্রশাসন খবর নেওয়ার আগেই ওই লোকের দাফন সম্পন্ন হয় বলে জানতে পারি।
মুন্সীগঞ্জের জেলা সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডা. আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাউকেই কিছু জানানো হয় নি। এমনকি স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছেও কোনো তথ্য দেওয়া হয় নি। ৯ এপ্রিল সকালে সেই লাশ দাফন হয়। এরপরে প্রশাসন গিয়ে সেই বাড়ি ও গ্রাম লকডাউন করেন। আমার কাছে তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, যে গাড়িতে সেই লাশ আসে সেই গাড়িতেও কিছু মানুষ ফিরে যায় ঢাকাতে। এমন অবস্থায় তাদের অবস্থান জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনভাবে তথ্য লুকানো আসলে দুঃখজনক।
সিরাজদিখানের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশফিকুনাহার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির বিষয়টি আমরা ৯ এপ্রিল জানতে পারি। এখন সেই গ্রাম পুরোটাই লকডাউন করা হয়েছে। সেই ব্যক্তির জানাজা ও দাফনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি আমরা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। একই সঙ্গে তাদের হোম কোয়ারেনটাইনে নেওয়া নিশ্চিত করছি। যিনি লাশের গোসল করিয়েছেন তিনি নারায়ণগঞ্জ থাকেন বলে জানা গেছে। তাকেও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
ইউএনও জানান, নিহতের দাফন সম্পন্ন করতে যাওয়া গোরখোদক বিল্লাল, নিহতের ভাই হাফেজ জাকারিয়া, নিকট আত্মীয় বাবু তালুকদার, নুরুজ্জামান ও সফিউল্লাহসহ প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো লকডাউন করে লাল নিশানা টানিয়ে দেওয়া হয়। ওসব বাড়িতে কাউকে প্রবেশ ও বাড়ি থেকে কেউ যাতে বাইরে বের হতে না পারে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (পরিচালক) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, সবাই যার যার নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন। তবে হাসপাতালে রোগী ভর্তি বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। এ ক্ষেত্রে আপনাদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের বক্তব্য নিতে হবে।’
আসগর আলী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাননি। তবে হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে সেই রোগীর স্বজনেরা ডিওআরবি অর্থাৎ রিস্ক বন্ড দিয়ে আসগর আলী হাসপাতাল থেকে রোগী বের করে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ঢামেকের একটি ইউনিটে রোগীর সংস্পর্শে আসা চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের হোম কোয়ারেনটাইনে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢামেক সূত্র।