Tuesday 10 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সামাজিক সংক্রমণে ছড়াচ্ছে করোনা, ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম


১১ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৫৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত সাতজন করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগেরই বিদেশি কিংবা বিদেশ ফেরত বাংলাদেশি কারও সংস্পর্শে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ দুজনকে শনাক্তের পর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম এখন স্থানীয় সংক্রমণের স্তর পেরিয়ে তৃতীয় স্তর অর্থাৎ সামাজিক সংক্রমণের স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। বন্দর নগরী এখন সামাজিক সংক্রমণ বিস্তৃতির প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে। কাঁচাবাজারসহ জনমসমাগম হয় এমন স্থান বন্ধ করে দিতে না পারলে এই সংক্রমণ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাটে ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ-এ (বিআইটিআইডি) চলছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সন্দেহে সংগ্রহ করা নমুনার পরীক্ষা। এ পর্যন্ত হাসপাতালের ল্যাবে চারশ’রও বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে, যার মধ্যে সাতজনের শরীরের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

বিআইটিআইডি’র পরিচালক ডা. এম এ হাসান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আক্রান্ত সাতজনের মধ্যে অন্তত চারজন সামাজিক সংক্রমণের শিকার। অর্থাৎ লোকাল ট্রান্সমিশন পেরিয়ে চট্টগ্রাম এখন সামাজিক সংক্রমণের স্তরে পৌঁছেছে। এই সংক্রমণটা হচ্ছে গুচ্ছ সংক্রমণ, যেটাকে আমরা স্টেজ-থ্রি বলছি। এই গুচ্ছ সংক্রমণ এখন এলাকাভিত্তিক হচ্ছে, প্রতিদিন সেটা ছড়িয়ে পড়তে থাকবে।’

চট্টগ্রামের বিআইটিআইডিতে গত ২৬ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত শুরু হয়েছে। ৩ এপ্রিল নগরীর দামপাড়া এলাকার বাসিন্দা ৬৭ বছর বয়সী একজন কোভিয-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। এর দুদিন পর ৫ এপ্রিল তার ছেলের শরীরেও করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির মেয়ে ও শ্বাশুড়ি ১২ মার্চ ওমরাহ শেষে সৌদিআরব থেকে চট্টগ্রামে ফিরে দামপাড়ার বাসায় উঠেছিলেন। তাদের কাছ থেকে ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন ওই ব্যক্তি এবং তার ছেলে। যদিও মেয়ে এবং শ্বাশুড়ির বিদেশ থেকে ফেরার ১৪ দিন পরও তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি।

এরপর গত ৮ এপ্রি বিআইটিআইডিতে আরও তিনজনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এদের মধ্যে একজন গৃহবধূ, যার বাসা চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকায়। তার স্বামী নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে কর্মরত। বাকি দুজন পুরুষ। এদের একজন নারায়ণগঞ্জে একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা, বাড়ি সীতকুণ্ড উপজেলায়। নারায়ণগঞ্জ লকডাউনের পর তিনি সীতাকুণ্ডে বাড়িতে আসেন। এরপর তার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত হয়। আরেকজন নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকার একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এদের তিনজনের কেউই কোনো বিদেশি অথবা বিদেশ ফেরত কোনো বাংলাদেশির সংস্পর্শে যাননি। তারা কীভাবে সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, সেটি সুনির্দিষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে, তারাও সামাজিক সংক্রমণের শিকার। এদের মধ্যে পোশাক কারখানার কর্মকর্তা আক্রান্ত শনাক্তের কয়েকদিন আগে নগরীর অলঙ্কার মোড়ে একটি কাঁচাবাজারে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এরপর শুক্রবার (১০ এপ্রিল) চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারের শিববাড়ি মোড়ের একজন কাঠ ব্যবসায়ী এবং আরেকজন নগরীর পাহাড়তলী থানার ঝোলারহাট কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সর্বশেষ যে দুজন শনাক্ত হয়েছেন, তারা কেউই বিদেশ ফেরত নন, তাদের বিদেশ থেকে আসার হিস্ট্রিও নেই। তারপরও কেউ কেউ বলেছেন, কাঠ ব্যবসায়ী ওমরাহ করে এসেছেন, কিন্তু আমরা দেখেছি, গত মার্চে তিনি দেশের বাইরে যাননি। তার ছেলেরা বিদেশে থাকেন বলা হচ্ছে, সে বিষয়েও আমরা নিশ্চিত নই। আমাদের ধারণা, বাজারে জনসমাগমের মধ্যেই দুজন সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। চট্টগ্রামে মৃদু কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে, এটা বলতে পারি।’

চট্টগ্রামে আক্রান্তরা কিভাবে সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন, সেটা তদন্ত করছে নগর পুলিশের বিশেষ শাখা। সিএমপির উপ-কমিশনার (বিশেষ শাখা) মো. আব্দুল ওয়ারিশ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমদিকে বাবা-ছেলে যাদের পাওয়া গেছে, তারা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই সামাজিক সংক্রমণের শিকার।’

বিআইটিআইডি’র পরিচালক ডা. এম এ হাসান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গুচ্ছ সংক্রমণ ঠেকাতে হলে যেটা করতে হবে, মানুষকে কোনোভাবেই এক হতে দেওয়া যাবে না। কমপক্ষে তিন ফুট, সম্ভব হলে ৬ ফুট দূরত্ব রাখতে হবে পরস্পরের মধ্যে। বাজার কিংবা জনসমাগম হয় এমন স্থানে মানুষকে যেতে দেওয়া যাবে না। বাজার বন্ধ করে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে।’

চট্টগ্রাম নগরীতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে গত ১৫ দিন ধরে কাজ করছে জেলা প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথবাহিনী। ১০ এপ্রিল থেকে সন্ধ্যার পর ঘর ছেড়ে বের হলে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সিএমপির পক্ষ থেকে নগরীতে পাঁচটি প্রবেশপথ অবরুদ্ধ করে ঢোকা এবং বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর ওষুধের দোকান ছাড়া অন্য সব দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত নগরীতে বের হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রয়োজনের তাগিদে বের হচ্ছে অনেকে। আবার নিছক ঘোরাঘুরি, আড্ডাবাজিও চলছে। আবার নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গলির মুখে স্থানীয়রা স্বেচ্ছায় ব্যারিকেড দিয়ে ভেতরে দোকান খোলা রাখছে, আড্ডা দিচ্ছে।

গত ১৫ দিন ধরে নগরীতে অভিযান পরিচালনাকারী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অন্যতম নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ-সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে আমাদের ১০টি টিম প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মাঠে থাকছি। যারা যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছেন, তাদের অনেককে জরিমানাও করছি। এর ফলে আগের থেকে এখন অবস্থা একটু বেটার হয়েছে। এখন সন্ধ্যার পর আর দোকান খোলা থাকছে না। অনেক হাউজিং এলাকায় নিজেরাই গেট লক করে রাখছে। তবে নিম্নবিত্তের এলাকাগুলোতে সচেতনতা কম। কাঁচাবাজারেও একটু ভিড় করার চেষ্টা হচ্ছে। এগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি।’

গত বুধবার (৮ এপ্রিল) নগরীর পতেঙ্গা থানার কাটগড় এলাকায় তিনটি গলিতে এলাকাবাসীর দেওয়া লকডাউনের সন্ধান পান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি, পতেঙ্গা) এহসান মুরাদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গলির মুখে বাঁশ দিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে ভেতরে প্রশাসনের কেউ ঢুকতে না পারে। অথচ ভেতরে গলির মধ্যে চা দোকান, পান-সিগারেটের দোকান এমনকি কসমেটিক্স পণ্যের দোকানও খোলা পেয়েছি। এজন্য জরিমানা করা হয়েছে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকার বিভিন্ন গলিতেও হঠাৎ অতি উৎসাহী লোকজন বাঁশ দিয়ে লকডাউন করে। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে আমি সেগুলো সরিয়ে দিয়েছি।’

চট্টগ্রাম ঝুঁকি টপ নিউজ সামাজিক সংক্রমণ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর