মূল্যযুদ্ধের অবসান, তেল উৎপাদন কর্তনে ঐতিহাসিক সমঝোতা
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০৪:৫২
নানা দেনদরবার শেষে ওপেক প্লাস ও অন্যান্য তেল উৎপাদক মিত্র দেশগুলো উৎপাদন কর্তনের এক ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছেছে। দৈনিক ৯৭ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হ্রাস করার ব্যাপারে একমত হয়েছে শীর্ষ তেল উৎপাদক ও রফতানিকারকদের এ জোট। এতে সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যকার বিধ্বংসী মূল্যযুদ্ধের অবসান ঘটলো। তবে ওপেকের পক্ষ থেকে এখনও কোনো ঘোষণা দেওয়া না হলেও সদস্য দেশগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ব্লুমবার্গ, আরব নিউজ, সিএনবিসি’র প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়।
ওপেক প্লাস জোট এবং জি-২০ দেশগুলোর মধ্যে সপ্তাহব্যাপী ফোনকল ও ভিডিও কনফারেন্সের পর অবশেষে মহামারির প্রভাবে নিম্ন চাহিদার বাজারে স্থিতিশীল অবস্থানে যাওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছেছে দেশগুলো। জ্বালানী তেল বিষয়ে সবচেয়ে বড় এ সমঝোতা টানা তিনদিনের ভার্চুয়াল সভার পর রোববার (১২ এপ্রিল) চূড়ান্ত হয়। এ সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সদস্যদেশগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন সালমান এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা আবারও প্রমাণ করেছি ওপেক প্লাস জীবিত আছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন- ওপেক এবং রাশিয়াসহ এর মিত্রদের একসঙ্গে ওপেক প্লাস বলা হয়। তবে ওপেকের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে সৌদি আরব।
আরও পড়ুন- তেলের মূল্যযুদ্ধে অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি
এর আগে ৯ এপ্রিল এ সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর মেক্সিকোর বিরূপ মনোভাবের কারণে তা ভেস্তে যায়। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সৌদি, রাশিয়া ও মেক্সিকোর মত শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো এবার ঐক্যমতে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী মেক্সিকো ২০১৬ সালের তথ্যানুসারে বিশ্বের ১৭তম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ। মার্কিন মধ্যস্থতায় এ সমঝোতায় রাজি হলেও দৈনিক মাত্র ১ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমাবে মেক্সিকো। উল্লেখ্য, মেক্সিকোকে দৈনিক ৪ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বহুল কাঙ্ক্ষিত এ সমঝোতা চুক্তিটির ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় জানান, ওপেক প্লাসের সঙ্গে বড় চুক্তিটি সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানী খাতের কয়েক লাখ চাকরী বাঁচবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানকে ধন্যবাদ জানাই। আমি ওভাল অফিস থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এটি সবার জন্যই ভাল চুক্তি।
The big Oil Deal with OPEC Plus is done. This will save hundreds of thousands of energy jobs in the United States. I would like to thank and congratulate President Putin of Russia and King Salman of Saudi Arabia. I just spoke to them from the Oval Office. Great deal for all!
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) April 12, 2020
রোববারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওপেক প্লাস সদস্য দেশগুলো দৈনিক ৯৭ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন কর্তন করবে। ব্রাজিল ও কানাডা কমাবে আরও ৩৭ লাখ ব্যারেল। তবে বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ওইসব দেশে তেল উৎপাদন এমনিতেই অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু জি-২০ এর অন্যান্য দেশগুলো এখনও কী পরিমাণ তেল উৎপাদন কমাবে তা জানানো হয়নি।
এদিকে, এ সমঝোতার আওতায় সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আরামকো তাদের ২৩ শতাংশ তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে জানিয়েছে।
ঐতিহাসিক এ সমঝোতার পর রাশিয়ার ক্রেমলিনের তরফ থেকে মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ বলেন, সমস্ত পৃথিবীর জন্য এটি দরকার ছিল। কারণ কোন সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে জ্বালানী তেলের অনিয়ন্ত্রিত দামের প্রভাব বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পড়ত।
এ সমঝোতার আওতায় উৎপাদন কর্তনের ফলে আগামী ১ মে নাগাদ বাজার থেকে ১০ শতাংশ তেল হ্রাস পাবে। তবে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বে তেলের চাহিদা ইতিমধ্যেই প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে।
সৌদি-রাশিয়া মূল্যযুদ্ধ
সৌদি আরব ও রাশিয়া বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ দুটি দেশ দৈনিক আড়াই কোটি ব্যারেলেরও বেশি তেল উত্তোলন করে থাকে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখনই হ্রাস পায় তখন দেশ দুটি উৎপাদন কমিয়ে পতন ঠেকায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই সৌদির সঙ্গে তেলের বাজারে মিত্র হিসেবে পরিচিত রাশিয়া। তবে এবার এর ব্যতিক্রম ঘটে।
৬ মার্চ অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন-ওপেকের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া। করোনাভাইরাসের কারণে ক্রমশ নিম্নমুখী বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় ওপেক। সৌদি আরব তেল উৎপাদক দেশগুলোকে দৈনিক অন্তত ১৫ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমানোর পরামর্শ দেয়। তবে এতে সম্মত হয়নি রাশিয়া। ওই দিন রাশিয়ার এমন সিদ্ধান্তের কারণে তেলের দাম এক দফা পড়ে যায়।
পরে রাশিয়া তেল উৎপাদন না কমিয়ে বরং বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। রাশিয়ার এ সিদ্ধান্তের পর দেশটিকে চাপে রেখে উৎপাদন কমাতে বাধ্য করতে সৌদি আরবও উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকো’কে তেল উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দেন দেশটির জ্বালানি মন্ত্রী। এতে ১ এপ্রিল থেকে আরামকো দৈনিক ১ কোটি ৩০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করবে বলে তখন সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতও উৎপাদন বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেয়।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় অবশেষে উত্তোলন কর্তনের সিদ্ধান্তে পৌছালো শীর্ষ উৎপাদক দেশগুলো। এতে সৌদি-রাশিয়ার মূল্যযুদ্ধেরও অবসান ঘটলো।