প্রবাসী আয়ে হোঁচট, করোনায় আটকে পড়া শ্রমিকদের ফেরাতে বৈঠক আজ
১৪ এপ্রিল ২০২০ ০১:৫১
ঢাকা: বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের প্রভাবে জনশক্তি রফতানির পরিমাণ নামছে শূন্যের কোঠায়। কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আসার হার। বিভিন্ন দেশে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, করোনার ধাক্কা সামলানোর পাশাপাশি বিদেশে করোনার কারণে আটকে পড়া শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথাও ভাবছে সরকার। আর যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, সেসব শ্রমিকদের সহায়তা দিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের কাছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠিয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে করণীয় ঠিক করতে আজ মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) বৈঠকে বসবে এ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি। বৈঠক থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ বেশকিছু বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫টি দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স যুক্ত হয় দেশের অর্থনীতিতে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, ইতালি, ওমান, সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, ফ্রান্স, জর্ডান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে এই ১৫ দেশের তালিকায়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের আক্রমণে এই দেশগুলোর প্রায় সবগুলোই আক্রান্ত। এর মধ্যে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তো রীতিমতো ধ্বংসলীলা চলছে। এসব দেশের সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক লেনদেন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। সৌদি আরব আন্তর্জাতিক সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কাতার জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ওইসব দেশের অধিকাংশ রেমিট্যান্স হাউজ ও ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছিল ১৬৯ কোটি ডলার। বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে এর পরিমাণ ছিল ১৬৪ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারিতে আরও ১৯ কোটি ডলার কমে তা দাঁড়ায় ১৪৫ কোটি ডলারে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো বড় দেশগুলোর বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। আবার কেউ কেউ লোকবল কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয়ের ব্যাপক আকারে কমার আশঙ্কা করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। সে আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হলে তা দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে। জনশক্তি রফতানিও সংকটে পড়বে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিমাসে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কর্মী কাজের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে যায়। সে হিসাবে বছরে ৬ থেকে ৭ লাখ জনশক্তি রফতানি হয়ে থাকে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মার্চ থেকে জনশক্তি রফতানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। আরও দুয়েকমাস বন্ধ থাকলে সেটা হবে বড় ধরনের ধাক্কা।
শরিফুল হাসান আরও বলেন, প্রায় এক কোটি শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাজ করছে। তাদের মধ্যে ২ শতাংশ কর্মজীবী, যারা তাদের নিয়মিত পারিশ্রমিকের ওপরে পুরোপুরি নির্ভর থাকেন না। বাকি ৯৮ শতাংশ নিয়মিত পারিশ্রমিক না পেলে দেশে টাকা পাঠাতে পারেন না এবং এর প্রভাব সেসব শ্রমিকদের পরিবারের ওপরে ব্যাপকভাবে পড়ে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিক ফিরে আসার তথ্য জানিয়ে ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা বলেন, গত দেড় মাসে প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক করোনাভাইরাসের কারণে দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৪২ হাজার, আরব আমিরাত থেকে ৩৮ হাজার, মালয়েশিয়া থেকে ১৯ হাজার, কাতার থেকে ১৪ হাজার, সিঙ্গাপুর থেকে ১৩ হাজার, ওমান থেকে ১২ হাজার, কুয়েত থেকে ৭ হাজার, ইতালি থেকে ৩ হাজার, মালদ্বীপ থেকে দেড় হাজার। দেশে ফেরা এসব শ্রমিক ওইসব দেশে আবার ফিরে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
জনশক্তি কর্মংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, বছরের শুরুর দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ১২৭ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এদের মধ্যে ৬৯ হাজার ৯৮৮ জন গেছেন জানুয়ারিতে, ফেব্রুয়ারিতে গেছেন ৫৯ হাজার ১৩৯ জন। তবে এই দুই মাসে বাহারাইন, লিবিয়া, ইতালি ও ইরাকে একজন শ্রমিকও যেতে পারেনি। আর এই দুই মাসে সুদানে গেছেন মাত্র একজন কর্মী গেছে। এরপর মার্চ থেকে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রয়েছে। উল্টো প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক ফিরে এসেছেন দেশে। ফলে উভয় দিক থেকেই সংকটে রয়েছে অভিবাসন খাতটি।
এ পরিস্থিতিতে যেসব দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক আটকা পড়েছেন, সেসব দেশের সরকারের কাছে শ্রমিকদের সুরক্ষা দিতে চিঠি পাঠিয়েছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকলেও কিভাবে এসব শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছে মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা সারাবাংলাকে বলেন, সৌদি আরব থেকে যারা দেশে ফিরেছেন, তাদের মধ্যে যাদের আকামা (কাজের অনুমতি) আছে, তারা ফিরে যেতে পারবেন। যারা ছুটিতে এসেছেন, তারা ফের কাজে যোগ দিতে পারবেন। এই মুহূর্তে সরকার শ্রমিকদের সুরক্ষা কিভাবে দেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবছে। করোনাভাইরাসের কারণে যেসব দেশে শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে আটকা পড়ে আছেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। আবার যারা আসবেন না, তারা সেখানেই কিভাবে সুরক্ষা পাবেন, সে বিষয়ে ওই সব দেশের সরকারদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে, চিঠিও পাঠানো হয়েছে।
যেসব শ্রমিক দেশে ফিরবেন, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথাও সরকার ভাবছে বলে জানান সচিব সেলিম রেজা। তিনি বলেন, যারা ফিরে আসবেন তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। দেশে যেন তারা কিছু করে খেতে পারেন, সে জন্যেই এই ব্যবস্থা।
সচিব জানান, এসব পরিকল্পনার সবকিছুই ঠিক হবে মঙ্গলবারের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে। প্রবাসীকল্যাণের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ও উপস্থিত থাকবে এই বৈঠকে। তিন মন্ত্রণালয়ই প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করছে বলে জানান সেলিম রেজা।
দেশের বাইরে শ্রমিকরা কিভাবে আছেন, জানতে যোগাযোগ করা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। ইমোতে কথা হয় মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে। তারা জানান, যারা স্থায়ী হয়েছেন, তাদের দুশ্চিন্তা কিছুটা কম। অস্থায়ী শ্রমিকদের অবস্থা খুব খারাপ। তাদের কাজ নেই। টাকা ফুরিয়ে গেছে। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হলেও সেই সহায়তা কেউ পেয়েছেন, কেউ পাননি। এ পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসতে চান তারা।
একই কথা জানিয়েছেন ইতালিতে থাকা শ্রমিক সাগর আহমেদ। তিনি স্থায়ী চাকরি করেন। তবে করোনাভাইরাসের কারণে তার প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে। তার আশঙ্কা, প্রতিষ্ঠান খোলার পরে বহু শ্রমিক ছাঁটাই করা হবে।
প্রবাসী আয় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশে আটকে পড়া শ্রমিক শ্রমিকদের ফেরানোর উদ্যোগ