Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘হালখাতা’র খাতা খোলেনি, ব্যস্ততম দিন আজ স্তব্ধতার


১৪ এপ্রিল ২০২০ ০৮:৩০

ঢাকা: বসন্তের শেষ এই সময়টায় পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যেকার ব্যস্ততার ধরনটা থাকে একটু অন্য রকম। নতুন বঙ্গাব্দকে কেন্দ্র করে প্রায় সব ধরনের পণ্যেরই বেচাবিক্রির বাড়তি চাপ তো থাকেই। এর বাইরেও থাকে পুরনো বছরের সব হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে নতুন বছর শুরু করার তাড়া। আর তা করতে গিয়েই পুরনো খাতার হিসাব ওঠে নতুন খাতায়, যেই খাতাটিই কি না ‘হালখাতা’ বললেই একনামে চেনে সবাই।

বছরের পর বছর ধরে এই যে হালখাতা, নতুন বছর বরণ করে নেওয়ার রীতি, এ বছরে এসে ছেদ পড়লো সেই ধারাবাহিকতায়। নভেল করোনাভাইরাস নামের এক আতঙ্ক যেখানে স্থবির করে দিয়েছে গোটা বিশ্ব, সেখানে বাঙালি প্রাণের উৎসব বঙ্গাব্দ বরণকেও বন্দি করেছে ঘরের কোণে। চৈত্র পেরিয়ে তাই বৈশাখ চলে এলেও নেই ব্যবসায়ীদের সেই তোড়জোড়, হালখাতার ব্যস্ততা, পহেলা বৈশাখে ক্রেতা-শুভানুধ্যায়ীদের মিষ্টিমুখ করানোর আনুষ্ঠানিকতা। করোনাভাইরাসের আক্রমণে ব্যবসায়ীরাই যে রয়েছেন রীতিমতো বেহাল দশায়।

বিজ্ঞাপন

‘হালখাতা’র ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই হালখাতার আয়োজনেও এসেছে ভিন্নতা। অনেকেই আগের মতো নিয়ম করে হালখাতা পালন করেন না। তবু পুরান ঢাকার অনেক ব্যবসায়ীই এই হালখাতার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চৈত্র সংক্রান্তি, অর্থাৎ বাংলা বর্ষপঞ্জির শেষ দিনটিতে, কেউ পহেলা বৈশাখ বা নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে পালন করে থাকেন হালখাতা। বছরের হিসাব চুকিয়ে দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্ক ঝালাই করে নেন আরও এক বছরের জন্য। আর নতুন বছরের প্রথম দিনের মিষ্টিমুখ তো রয়েছেই। সে মিষ্টিমুখের আয়োজন চলে পুরো বৈশাখ মাসেই।

বিজ্ঞাপন

এ তো গেল একদিকের কথা। পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা ঘিরে থাকে আরও কিছু ব্যস্ততা, আরও কিছু আয়োজন। ব্যবসায়ীরা যখন হালখাতা খুলতে ব্যস্ত, তখন সেই খাতা সরবরাহের জন্যও পুরান ঢাকার অলি-গলি কর্মমুখর হয়ে ওঠে দুয়েক মাস আগে থেকেই। অন্যদিকে নতুন বছর সামনে রেখে শুরু হওয়া পঞ্জিকা তৈরির কাজও। শুভ দিনক্ষণের উপলক্ষ নির্ধারণে এই পঞ্জিকার ওপরই যে নির্ভর করে থাকেন অনেকেই। আবার হিন্দু ব্যবসায়ীদের জন্য গণেশ প্রতিমা গড়ার কাজেও নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতেন কুমোররা।

এ বছর যেন সবকিছুতে বিরতি। সব কর্মব্যস্ততার যেন অবসান ঘটিয়েছে এক করোনাভাইরাস। চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই বন্ধ শপিং মল, ফ্যাশন হাউজ থেকে শুরু করে সব ধরনের দোকানপাট। পুরনো বছরের হিসাব মিলিয়ে নতুন বছরের হিসাব শুরু করার জন্য খোলা নেই কোনো দোকান। হালখাতা খোলার মতো বাস্তবতাই নেই। তাই এ বছর লাল মলাটে মোড়ানো খাতা তৈরির ব্যস্ততাও নেই অলিগলিতে, নেই কুমোরদের গণেশ প্রতিমা গড়ার আয়োজন, নেই প্রেসে পঞ্জিকা ছাপানোর ঘটাং ঘটাং শব্দ। সব থেমে গিয়ে যেন এক স্থবিরতা পুরান ঢাকার পথেঘাটে।

শুধু কি তাই? জনসমাগম এড়াতে প্রতিটি সড়কে সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পাহারা। একের অধিক মানুষ একসঙ্গে দেখলেই দণ্ড। ফলে সড়কও জনশূন্য। জরুরি সেবার দুয়েকটা দোকান বাদে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শাটারই নামানো। বছরের ব্যস্তততম সময় এখন ব্যবসায়ীরা পার করছেন শুয়ে বসে!

শাঁখারীবাজারের মা মনসা শঙ্খ ভাণ্ডারের যতীন্ত্র নাথ বললেন, এটা আমাদের ব্যবসার যেমন অন্যতম সময়, তেমনি হিসাব-নিকাশ, পাওনা আদায়েরও বিশেষ সময়। এ বছর যে অবস্থা, তাতে ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে।

ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক। ব্যবসা বন্ধ থাকার দুশ্চিন্তা ঘিরে রেখেছে তাকে। রাজ্জাক বলেন, হালখাতা দূরে থাক, দেশের যে পরিস্থিতি, তাতে ঘর থেকে কবে বের হওয়া যাবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। দীর্ঘদিন যদি ব্যবসা বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে তো ঋণগ্রস্ত হয়ে যেতে হবে।

লাল কাপড়ে মোড়ানো খাতা তৈরিতে এই সময়ে হাজারও শ্রমিক জড়িয়ে থাকলেও এ বছর তাদের দেখা নেই। খাতা উৎপাদনকারী একাধিক ব্যবসায়ী জানালেন, বছরের বড় একটি আয়ই তারা করে থাকেন এই একটি মৌসুমে, যা দিয়ে কয়েক মাস চলে যায়। এ বছর সে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এর ধাক্কা বছরজুড়ে টানতে হবে। ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীরা আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না, তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।

এদিকে, এই সময়ে হিন্দুদের মধ্যে নতুন পঞ্জিকা কেনার হিড়িক থাকে। ১২ মাসের ১২-তিথি-নক্ষত্র, শুভ ক্ষণ, লগ্ন, রাশিফল, একাদশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা জানতে বাঙালি হিন্দুদের ভরসা এই পঞ্জিকা। গোলাপি মলাটে লোকনাথ হাফ পঞ্জিকা কেনা শুরু হয় চৈত্রের শেষে। আর তা অনেকেই পুরান ঢাকার শাঁখারি কিংবা তাঁতীবাজার থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। এবার করোনাভাইরাসের কারনে দোকান-পাট বন্ধ থাকায় তা আর কেনা হচ্ছে না।

পুরান ঢাকায় বাসিন্দা মিনাক্ষী সাহা বলেন, পঞ্জিকা আগেভাগেই বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু কেউই নতুন পঞ্জিকা আগে কেনেন না। কারণ ওটা নতুন বছরেই প্রয়োজন হয়। এবার অবরুদ্ধ দোকানপাট। তাই শুভ ক্ষণ দেখা কিংবা পূজার সময় দেখা মুশকিল হয়ে যাবে।

পুরান ঢাকার বাংলাবাজার, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজারের মতো এলাকাগুলো চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখের দিনটিতে সেজে ওঠে নতুন সাজে। গতকাল চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিও যেমন স্তব্ধ ছিল, ঠিক একইরকম স্তব্ধতা ঘিরে থাকবে আজকের পহেলা বৈশাখের দিনটিতেও। ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির হিসাব তো আছেই, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন সবার মনে— করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে কবে?

নতুন বছর নববর্ষ হালখাতা হিসাব নিকাশ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দশম গ্রেড দাবি করায় ৬৪ অডিটরকে বদলি
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৫

সম্পর্কিত খবর