বৈশাখের অগ্নিস্নানে দূর হোক ‘করোনা’, শুচি হোক ধরা
১৪ এপ্রিল ২০২০ ১২:০২
তোমার গেরুয়া বস্ত্রাঞ্চল
দাও পাতি নভস্তলে, বিশাল বৈরাগ্যে আবরিয়া
জরা মৃত্যু ক্ষুধা তৃষ্ণা, লক্ষকোটি নরনারী-হিয়া
চিন্তায় বিকল।
দাও পাতি গেরুয়া অঞ্চল।
ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ! [বৈশাখ/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
বলতে গেলে প্রতিবছরই বৈশাখ আসে রুদ্র রূপ নিয়ে। কখনও প্রচণ্ড দাবদাহ, আবার কখনও কালবৈশাখীর করাল থাবায় তার রুদ্র রূপের প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু বৈশাখী ঝড় অথবা তুমুল বৃষ্টিতে ধরণীতে নামে শান্তির পরশ। আর এই শান্তিযাত্রা নিয়েই শুরু হয় নতুন বছর। সময়ের পালকিতে চড়ে চিরায়ত নিয়মে বাংলা পঞ্জিকায় এসে আবারও যুক্ত হলো আরেকটি নতুন বছর। নতুন স্বপ্ন আর সম্ভাবনার এই ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শুরুটায় বৈশাখের রুদ্র রূপের প্রকাশ ঠিক কেমন হবে সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে বৈশাখ আগমনের আগেই অদৃশ্য এক কালোমেঘ এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলেছে। সেই অদৃশ্য কালো মেঘের নাম করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯), যা এরই মধ্যে পৃথিবীব্যাপী মহামারি রূপ ধারণ করেছে। একবিংশ শতকের প্রথম বৈশ্বিক মহামারির ছোবল থেকে বাঁচতে ফিকে হয়ে গেছে সব উৎসব-আয়োজন। অদৃশ্য ভাইরাস আতঙ্কে থেমে গেছে সুখী কৃষকের গান।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাঙালি এখন ঘরে অবস্থান করছে। বৈশ্বিক মহামারির হাত থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি মাথায় রেখে তাই এবার বাতিল করা হয়েছে উন্মুক্ত ও জনাকীর্ণ সব অনুষ্ঠান। এ ঘটনায় বাংলা ভাষাভাষী জনপদে বিষাদের ছায়া নেমে এলেও সংক্রমণ ঠেকাতে সবাই এবার ঘরেই নববর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গ্রাম্যমেলা, পুতুল নাচ, চড়ক-গাজন উৎসবের বদলে টিভিতে বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখেই কাটছে সময়। কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মেলানোর বদলে সবাই মেনে নিয়েছেন সামাজিক দূরত্ব। কারণ নতুন বছরে অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে জিততে হলে এভাবেই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে!
১৯৬১ সালে যাত্রা শুরু করা ছায়ানট ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিবছর রমনার বটমূলে নববর্ষের ভোরে অনাগত ভবিষ্যতকে স্বাগত জানিয়ে আসছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বছরটি বাদে একবারও সত্য সুন্দরের গান থামায়নি এরা। কিন্তু এবার ছায়ানটকে থামিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। ছায়ানটের সভাপতি ও বাংলা সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব সনজীদা খাতুনের কণ্ঠে তাই ঝরে পড়ল বর্ষবরণ করতে না পারার আক্ষেপ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘১৯৬১ সালে যাত্রা শুরুর পর মাত্র দুবার থামতে হলো আমাদের। একবার দৃশ্যমান শত্রু থামিয়ে দিয়েছিল বাঁশির সুর; আর এবার থামাল অদৃশ্য জীবাণু।’
কাজী মোতাহার হোসেন তনয়া আরও বলেন, ‘আমরা কিন্তু থামছি না। বাঙালির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সীমিত আকারে পয়লা বৈশাখের সকালে বাংলা বর্ষবরণ আয়োজন করবে ছায়ানট। পুরো অনুষ্ঠানটি দেখাবে বিটিভি।’
ছায়ানট জানিয়েছে, গত কয়েকটি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নির্বাচিত ভিডিও দিয়ে সাজানো হবে এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখ সকাল সাতটায় এই অনুষ্ঠান দেখাবে বিটিভি। তাতে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন বক্তৃতাও করবেন।
বাংলা বর্ষবরণের আরেক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো কর্তৃক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই অনুষ্ঠানও এবার বাতিল করা হয়েছে। তার বদলে প্রকাশ করা হয়েছে একটি পোস্টার। যার নকশা করেছেন চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক নিসার হোসেন।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এবার শোভাযাত্রা করা যাচ্ছে না, তাই মন খারাপ। তবে আমরা যে পোস্টারটি নকশা করেছি সেটি অন্তর্জালের মাধ্যমে ঘুরবে সারাদেশে। শোভা পাবে রাজধানীর দেয়ালেও। এর স্লোগানের মাধ্যমে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষকে শক্তি যোগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’
শিল্পকলার প্রবীণ এই অধ্যাপক জানান, কালো জমিনের ওপর লাল, সাদা ও হলুদ রঙের বর্ণমালায় লেখা হয়েছে স্লোগান। এবারের স্লোগান ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’। পোস্টারের শীর্ষে বৈশাখ ১৪২৭ লেখার পর রক্তিম বর্ণমালায় ওপরের অংশে লেখা হয়েছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্যা সি’ উপন্যাসের বিখ্যাত সংলাপ ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু মানুষ পরাজিত হয় না’। তার নিচে সাদা বর্ণমালায় লেখা হয়েছে ‘এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ সেরা। বর্তমানের এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ জয়ী হবেই।’ এই লেখার পর বড় অংশজুড়ে দৃশ্যমান হয়েছে একটি বর্ণিল সরাচিত্র। এর নিচে লেখা এবারের বৈশাখের মূল স্লোগান।
নতুন বছরের প্রথম দিনে এই সব উৎসব আয়োজন থেমে যাওয়ায় বড় প্রভাব পড়েছে ইলিশের বাজারেও। এই সময়ে সোনার হরিণ হয়ে ওঠা ইলিশ নিয়ে এবার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। করোনা কারণে ইলিশ কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় সাধারণ মানুষেরা মাছের রাজার বাজারদরও জানার চেষ্টা করছে না তেমন!
অন্যান্য বছর বৈশাখী উৎসব শুরু হতে না হতেই মাছের আড়তগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় থাকতো। সাগরজলে বেড়ে ওঠা ইলিশের দামও হয়ে যেত আকাশচুম্বি। প্রাপ্তবয়স্ক একটি ইলিশ কিনতে গুনতে হতো এক হাজার, দুই হাজার থেকে কখনও পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রাশেদ শাওন বলেন, ‘আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাস করি, তাদের জন্য বৈশাখের চেয়ে বড় কোনো উৎসব নেই। বৈশাখ মানেই সরষে ইলিশ আর নানান পদের ভর্তা দিয়ে মাখানো ভাত। কিন্তু এবার ইলিশের দাম কত সেটাই জানি না! করোনার কারণে বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। এমনকি বাইরের পৃথিবীর খোঁজও রাখা হচ্ছে না তেমন। সবার মধ্যেই একটা মৃত্যুভয় কাজ করছে। অজানা আশঙ্কায় লীন হয়ে গেছে উৎসবের আমেজ।’
ঢাবি শিক্ষার্থীর সাজ্জাদ চৌধুরী বলেন, ‘গেল বছর বৈশাখেও লাইব্রেরির সামনে ইলিশের দোকান দিয়েছিলাম। ব্যবসা নয়, আনন্দটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। এবার সেটি করা যাচ্ছে না। এমনকি ইলিশ আনিয়ে ঘরে খাব সেই সুযোগও নেই। আমরা সবাই সামাজিক দূরত্ব মেনে বাসায় অবস্থান করছি। এখন এটি করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও দেখছি না।’
ইলিশের বাজারের মত শাহবাগের খেলনা ও ফুলের দোকানগুলোতেও লেগেছে করোনাকালের মন্দার বাতাস। পুষ্প বিহার দোকানের স্বত্বাধিকারী সঞ্জয় রায় বলেন, ‘শুধু বৈশাখ নয়, ঢাকা শহরে এখন বিয়ে উৎসবও বন্ধ হয়ে গেছে। ফুল বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ। লকডাউন শুরু হওয়ার পর আশা করেছিলাম বৈশাখে বিক্রি হবে। কিন্তু এখনও লকডাউন শেষ হয়নি। হলে আর সবার মতো আমাদের কাছেও পহেলা বৈশাখ এখন সাধারণ আরেকটা দিন মাত্র।’
পহেলা বৈশাখের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো হালখাতা। এই হালখাতার জন্য আগের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের হিসাবের খাতা বন্ধ করে দেন। নববর্ষের প্রথম দিনে খোলেন খাতার নতুন পাতা। এ উপলক্ষে ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ করে মিষ্টিমুখ করানো হয়। বিপরীতে ক্রেতারাও মিটিয়ে দেন দেনা-পাওনার হিসাব। এতে করে ক্রেতা ব্যবসায়ীর সম্পর্ক আরও মধুর এবং দৃঢ় হয়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের কোথাও হালখাতার আয়োজন করছেন না ব্যবসায়ীরা।
কারওয়ান বাজারের আড়তদার ফুল মিয়া বলেন, ‘অনেকের সঙ্গে দেনা-পাওনা না মিটিয়েই হিসাবের খাতা বন্ধ করে দিয়েছি। এই পরিস্থিতিতে হালখাতা আয়োজন করা সম্ভব নয়। আপাতত দেশের মানুষ বিপদ থেকে রক্ষা পাক। এরপর উৎসব করা যাবে।’
এদিকে সমতলের বাঙালিদের মতো পাহাড়ের নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসবও ফিকে হয়ে গেছে। প্রতি বছর এই সময় সবুজ পাহাড়ি জনপদ উৎসবে মুখর থাকলেও এবার মহামারির প্রভাবে পাহাড়ের উৎসবও থেমে গেছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে বাংলা বর্ষবিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করতে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, তনচংগ্যারা বিষু এবং ত্রিপুরারা বৈসুক পালন করে। এবার উৎসবগুলো সীমিত পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বেশিরভাগ পরিবারই কাপ্তাই লেকের বদলে নিজেদের বাড়ির ছাদে পানি ছিটিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে।
কৃষিকাজের সুবিদার্থে সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ অথবা ১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। মুঘল এই সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে হিজরি চান্দ্রসন ও সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। সনটি প্রথমে ফসলি সন নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে পহেলা বৈশাখ উৎসবের মতো করে পালন শুরু করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার। এ থেকেই বাংলা ভাষাভাষি জনপদগুলোতে জনপ্রিয় হতে থাকে এই উৎসব।
এবারের বাংলা নববর্ষের উন্মুক্ত উৎসব বন্ধ হলেই বা কি আসে যায়। একটা যুদ্ধের মধ্যে থেকে আমরা ঘরে বসেই রাঙাবো আমাদের বৈশাখী দিন। আর প্রত্যাশা থাকবে সব গ্লানি-জ্বরা মুছে গিয়ে ফিরবে রঙিন দিন। রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মতোই বৈশাখ সবকিছুকে বিশেষ করে অদৃশ্য করোনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাক পৃথিবী থেকে।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।