দেহে দেহে দুর্গ গড়তে হবে, অ্যান্টিবডি-প্লাজমায় জোর দিতে হবে
১৯ এপ্রিল ২০২০ ২৩:০৪
ঢাকা: ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-২৯) কারণে সৃষ্ট মহামারি খুবই জটিল আকার ধারণ করেছে। ভাইরাসটা নতুন হওয়ায় এখনও এর কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তাই কোভিডের সংক্রমণ থেকে সহজে বের হওয়ার সুনির্দিষ্ট পথের দেখাও মিলছে না। তবে ভাইরাসটি প্রতিরোধে যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি।
সমন্বিত পরিকল্পনাগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ের ভাগ করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় জরুরি ভিত্তিতে মানুষের দেহে দেহে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন অ্যান্টিবডি টেস্ট এবং প্লাজমা থেরাপি বাস্তবায়ন। করোনা প্রতিরোধে চিকিৎসাকর্মীসহ অন্য ক্ষেত্রের যারা প্রথম সারিতে কাজ করছে সবার আগে তাদের অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে পারলে সহজেই এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশাল যোদ্ধাদল গড়ে তোলা সম্ভব। আর প্লাজমা থেরাপিতে বিশাল ডোনার গ্রুপ তৈরি করে সহজেই আক্রান্তদের সেবা দেওয়া যাবে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কৃতি সংগঠক অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপে করোনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেন।
ডা. লিয়াকত আলি বলেন, “করোনা প্রতিরোধে বায়োলজিকেল একটি অস্ত্র রয়েছে, যা কাজে লাগাতে হবে, সেটা হলো অ্যান্টিবডি। কারণ মানুষের দেহ-ই হচ্ছে রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় দুর্গ। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, আমাদের এখন ভাষ্য হবে ‘দেহে দেহে দুর্গ গড়ে তোলো’। ভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের শরীর প্রস্তুত রাখতে হবে। শরীর প্রস্তুত রাখতে হলে পুষ্টি ভালো থাকতে হবে। শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন ভালো থাকতে হবে। আমাদের পুষ্টি ভালোই ছিল। কিন্তু করোনাকালে অনেকেরই পুষ্টি ফল করছে। অনেকেই দুঃস্থ এবং অভাবী মানুষদের ভাত, চিনি, আলু দিচ্ছি। কিন্তু তার সঙ্গে শাকসবজি পাচ্ছে না। আবার অনেকেই ভিটামিন, পুষ্টি বা প্রোটিন পাচ্ছে না। তাই আমাদের দ্রুত এই পুষ্টি, ভিটামিন, প্রোটিন বা খাদ্য নিরপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এই সময়ের খাদ্য নিরাপত্তা অন্য সময় (বন্যা বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যাগ) থেকে ভিন্ন। তাই এটাকে এখন পুষ্টি নিরাপত্তা বলাই শ্রেয়। অন্য সময় থেকে এই সময়ে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই লকডাউনে মানুষকে ক্ষুধা থেকে বাঁচানোই কিন্তু যথেষ্ট নয়, তাদের খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।’
আর পড়ুন: লকডাউন নয়, সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি
তিনি বলেন, ‘অন্যদেশ যারা লকডাউন করেছে তারা সম্পূর্ণ পুষ্টিকর প্যাকেজ খাবার তাদের জনগণকে সরবরাহ করতে পেরেছে। তাই তাদের জন্য লকডাউন ঠিক আছে। যেমন কেরালায় তারা তাদের নাগরকিদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করেছে, এখন আমরা কেরালার মত হতে পারলে সমস্যা ছিল না। আমরাতো যে খাদ্য দিচ্ছি সেগুলো সবই শুকনা খাবার বা ক্যালরি, সেখানে যথেষ্ট পুষ্টি নেই। তাই লকডাউন মডেল আমাদের জন্য ঠিক নয়। কেননা লকডাউনের পর আমাদের মানুষগুলো যখন বাসা থেকে বের হবে তখন তারা দুর্বল হয়ে বেরুবে। তখন ভাইরাসের ছোট্ট আক্রমণেই তারা আক্রান্ত হয়ে যাবে।‘
অ্যান্টিবডি বিষয়ে অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি বলেন, ‘বায়োলজিকেল অস্ত্র বা অ্যান্টিবডি কার শরীরে কেমন তা দ্রুত টেস্ট করতে হবে। দেখা যাবে যে, একটা পরিবারে একজনের হয়তো ছিল সাব ক্লিনিক্যাল, যার করোনা রোগ হয়নি। বহু মানুষের হয়তো এমন হয়েছে। নেদারল্যান্ডে দেখা গেছে, ১৭ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৩ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। মানে নেদারল্যান্ডের মতো জায়গায় প্রায় দেড় লাখের মতো মানুষের অ্যান্টিবডি হয়ে গেছে। সেখানে আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশিগুণ সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা হয়েছে। তাদের তুলনায় আমাদের দেশে ওইভাবে সামাজিক দূরত্ব মানাই হয়নি। সেই হিসেবে আমাদের দেশে অনেক অনেক গুণ বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার কথা। আর এটা টেস্ট না করলে বোঝা যাবে না। এখন সেই অ্যান্টিবডি পরিমাপ করে দেখতে হবে যে, সেখানে হিমোগ্লোবিন জি এর উপস্থিতি কী পরিমাণ। কেননা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিমাণ মতো হিমোগ্লোবিন জি থাকলে এই অ্যান্টিবডি এক বছরের জন্য ঠিক থাকে। মাঝখানে কারও যদি আবার রি-ইনফেকশন হয় সেক্ষেত্রে তার বুস্টার ডোজ হয়ে যাবে, যা ভ্যাকসিনের মতো। জার্মানি প্রতি সপ্তাহে ৫ লাখ মানুষের ওপর এই টেস্ট চালাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেদারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা বলছে যে, আমাদের দেশে বহু লোকের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। তাই এটা মাপা বা পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে মহিলারা খুব এগিয়ে আছেন। ধারণ করা হচ্ছে যে, পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিবডি তৈরির পরিমাণ তিনগুণ বেশি। তাহলে এই বায়োলজিক্যাল অস্ত্র বা অ্যান্টিবডি নির্ণয়ের বিষয়টি যদি প্রথমে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের (চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংবাদকর্মী) আগে পরীক্ষা করা হয়, তাহলে বড় একটি সৈনিক দল পাওয়া যাবে; যাদের করোনা প্রতিরোধে মাঠে নামানো যাবে। কারণ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতার সনদ (ইমিউনজিকেল পাসপোর্ট) পাওয়া যাবে। টেস্ট করে এই সনদ দিয়েও দেওয়া যেতে পারে। জার্মানি, ইতালি এই ধরনের পরীক্ষা করে সনদ দিচ্ছে। আমরাও যদি এমন একটি বিশাল দল তৈরি করতে পারি তবে এই গ্রুপ থেকে স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মী সহজেই ঠিক করা যাবে। কেননা তারা পরীক্ষিত হয়ে থাকবে যে, তাদের অ্যান্টিবডি হয়ে গেছে, তাদের আর ভয় নেই।’
অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি বলেন, ‘এরপরে ফেজওয়াইস গেরিলার মতো গুচ্ছ গুচ্ছ লকডাউন শিথিল করে করে অর্থনীতিকে সচল করতে হবে। এগুলো হচ্ছে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা। মূল জায়গায় আমরা যদি হাত না দিই তাহলে সফলতা আসবে না। অ্যান্টিবডি টেস্টের সঙ্গে আরেকটা খুব বড় ব্যাপার জড়িত, তা হচ্ছে- যাদের খুব ভালো অ্যান্টিবডি রয়েছে তাদের সেরাম বা প্লাজমা সংগ্রহ করা। এই থেরাপি একটা বড় অস্ত্র। চিকিৎসা জগতে এটা একটা বড় বিপ্লব। কারণ করোনার ওষুধ নিয়ে এখন যা বলা হচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞিানিক কোনো ভিত্তি নেই। এগুলো নিয়ে এখন রাজনীতি হচ্ছে। তাই প্রতিরোধের জন্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ভরসা হচ্ছে প্লাজমা থেরাপি। এতে বিশাল ডোনার গ্রুপ তৈরি করা যাবে। যেমন ডেঙ্গুর সময় আমরা বিশাল গ্রুপ থেকে প্লাটিলেট সংগ্রহ করে অনেক চিকিৎসা দিয়েছি- এই থেরাপিটাও প্রায় একই ধরনের। সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই শক্তিটা আমাদের অর্জন করতে হবে।’
শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কৃতি সংগঠক এই অধ্যাপক বলেন, ‘এজন্য সবার আগে আমাদের প্রয়োজন করোনা মোকাবিলায় যত দ্রুত সম্ভব একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। কেননা আন্তঃমন্ত্রণালয়, আন্তঃসংগঠন এবং আন্তঃব্যক্তির সহযোগিতা ছাড়া এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা অনেক ক্ষেত্রেই একপেশে হয়ে যায়। স্বস্থ্যের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, সড়ক যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার, পুলিশ-আর্মি, খাদ্য, ত্রাণ ও তথ্যসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সমন্বিত পরিকল্পনা করে একটি এক্সিট প্লান করতে হবে। যেখানে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থাকবে। এবং কার কী করণীয় তার উল্লেখ থাকবে।’