১৩০ বছর ধরে রেলের বেতন যায় ট্রেনে!
২১ এপ্রিল ২০২০ ১৩:০৪
ঢাকা: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের নীতিমালা প্রণয়ন করে। ওই নীতিমালায় ২০২১ সাল নাগাদ ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকারের কথা বলা আছে। সেই অঙ্গীকার অনুযায়ী বর্তমানে শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি বা ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এমনকি বাংলাদেশের অর্থনীতিও এখন ডিজিটাল প্লাটফর্ম ‘অনলাইন ব্যাংকিং’র মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু শুনতে অবাক লাগার মতো হলেও বিশ্বায়নের এই যুগে এখনও বাংলাদেশ রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনের টাকা বস্তায় ভরে ট্রেনে করে স্টেশন থেকে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া হয়।
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) রোধে গণপরিবহণ লকডাউনের কারণে হঠাৎ এই টাকা নিয়ে রেলের একটি ইঞ্জিন ও বগি ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পর বিষয়টি সামনে উঠে আসে। সম্প্রতি রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতনের টাকা নিয়ে ট্রেনটি সিলেট যায়। রেলের ঊর্দ্ধতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১৮৯০ সাল থেকেই এমনটা চলে আসছে। কর্মচারীদের বেতনের প্রক্রিয়াটি আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে বেশ ক’বছর ধরেই। কিন্তু এগোয়নি। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংকে বেতন স্থানান্তর কার্যক্রম এখনও চালু করা যায়নি।
সম্প্রতি একটি গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে জানায় যে, লকডাউন ভেঙে রেলের কর্মকর্তার জন্য ইলিশ আনতে গেছে ট্রেন। পাশাপাশি ট্রেনটি যাত্রীও বহন করেছে। এরপরই মূলত লকডাউনে ট্রেন যাত্রার আসল কারণ বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, রেলের কর্মচারীদের বেতন দিতেই ওই ট্রেনটি সিলেটে গিয়েছিল।
এই বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘লকডাউন ভেঙে ট্রেন ইলিশ আনতে গেছে বা যাত্রী টানছে- বিষয়টি মিস-রিপোর্টিং। রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে বহুকাল থেকেই এ প্রথা চলে আসছে। আর সিলেটে ট্রেন গিয়েছিল নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মচারীদের এক কোটি টাকার বেশি বেতনের ব্যাগ নিয়ে। এর মধ্যে অবৈধভাবে যাত্রী উঠানো হতে পারে, যা তদন্ত করে দেখছে রেলওয়ে।’ অভিযোগ আসায় দায়িত্বে থাকা কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
২০২০ সালে এসেও ট্রেনে করে বেতনের টাকা পরিবহনের ঘটনা এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আলোচনায় এসেছে। রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন ব্যবস্থায় যে অ্যানালগ পদ্ধতি রয়ে গেছে তা অনেকের জানা ছিল না। অনেকেই বলছেন, কেন রেলে এতদিন ইএফটি হলো না? রেলের লোকজনও এ ব্যাপারে কখনও কথা বলেননি। এভাবে ট্রেনে টাকা পরিবহন করায় বেতন ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির অভিযোগ খোদ রেলওয়ের ভেতরে। ইএফটি কার্যকর করতে রিফর্ম প্রোগ্রামে নেটওয়ার্ক করাসহ অনেক উদ্যোগ থাকার পরও মন্ত্রণালয়ের অবহেলায় এটি হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
রেল মন্ত্রণালয়ে সদ্য যোগ দেওয়া অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন জানান, শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ডিভিশনে (পুর্বাঞ্চল) রেলের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারির বেতন বর্তমানে নগদের পরিবর্তে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রেলের পূর্বাঞ্চল ফিন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগ প্রায় ২ হাজার ৭০০ পেনশন গ্রহীতার মধ্যে চলতি মাসে ইএফটির মাধ্যমে পেনশন দিয়েছে। বাকি রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ জন। তবে ৫ হাজার ৫০০ পেনশন গ্রহীতার ডাটা অ্যান্ট্রি হয়ে গেছে। সামনে তারাও ইএফটির মাধ্যমে পেনশন পেয়ে যাবেন। ডাটা অ্যান্ট্রির কাজ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ডিসেম্বরের মধ্যেই পূর্বাঞ্চলের অবশিষ্ট পেনশন গ্রহীতারা ইএফটির মাধ্যমে টাকা তুলতে পারবেন।
তিনি জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ডিভিশনে প্রায় ৮৪ জন কর্মকর্তার বেতন ইএফটির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। বাকিদের ইএফটির কাজ দ্রুত শেষ হবে। একই কাজ শুরু করতে পারেনি ঢাকা ডিভিশন (কয়েকজন কর্মকর্তার ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা ছাড়া) এবং সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল। সকলের বেতন-ভাতা নগদে দেওয়া হচ্ছে। এ জন্যই লকডাউনের মধ্যেও বিভিন্ন পয়েন্টে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে দুই-চার বগির রেক চালাতে হচ্ছে। আর বেতন-ভাতা ও পেনশনের এই নগদ টাকা তুলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হয় রেল কর্মচারীদের– উল্লেখ করেন অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, টাকা বস্তায় ভরে ট্রেনে পরিবহন করে বেতন দেওয়ার আদি পদ্ধতির মাধ্যমে হয়রানি শিকার হচ্ছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। যারা বেতনের এই নগদ টাকা কর্মচারীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তারা একশ, দুইশ থেকে শুরু করে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত নিজেদের পকেটে রেখে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
সূত্র জানায়, রেল বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন পেয়ে থাকেন। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অবসরপ্রাপ্তরাসহ রেলের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনও বেতন পান অ্যানালগ পদ্ধতিতে। ফলে আগের মাসের বেতন হাতে পেতে চলে যায় পরের মাসের অর্ধেকেরও বেশি সময়।
সম্প্রতি সিলেটে আসা ট্রেনে আখাউড়া থেকে শুরু করে সিলেট পর্যন্ত মেকানিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্রাফিক, রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনী (আরএনবি) ও ইলেক্ট্রিক শাখায় কর্মরত সহস্র কর্মচারীর বেতন আসে। আখাউড়া থেকে প্রতিটি জংশনে ট্রেন থামিয়ে এই বেতন দিয়ে আসেন রেলের বেতন ক্লার্করা।
শুধু সিলেটেই কর্মরত অন্তত ৩০০ কর্মচারীর ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বেতন আসে বলে জানিয়েছেন সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক খলিলুর রহমান।
বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে শত বছরের পুরানো অ্যানালগ পদ্ধতি বাতিল করে শিগগিরই ইএফটি কার্যক্রম চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
১৩০ বছর ১৮৯০ সাল ট্রেন নুরুল ইসলাম সুজন বস্তা রেলপথমন্ত্রী রেলের বেতন