Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যে কারণে হটস্পট ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর


২২ এপ্রিল ২০২০ ২২:১৮

ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে দেশে আক্রান্তের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সংক্রমণের তথ্য থেকে দেখা যায়, সিটি করপোরেশন বা পৌর অঞ্চলে করোনায় আক্রান্তের হার যেভাবে বাড়ছে, সে তুলনায় প্রান্তিক এলাকা কিছুটা হলেও নিরাপদে রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কবলে পড়েছে রাজধানী ঢাকা এবং এর পাশের দুই সিটি করপোরেশন ও জেলা শহর নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর। বলা যায় দেশের সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত অঞ্চল এই তিন জেলা। তাহলে কেন এই তিন জেলা পরিণত হয়েছে করোনাভাইরাসের হটস্পটে?

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশন বা উন্নত হিসেবে পরিচিত জেলা শহর হলেও এসব শহরে নেই নাগরিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা। এসব শহর বা নগর অঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার হওয়ার কথা। অথচ দেশের কোনো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাতেই নাগরিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার শতভাগ ব্যবস্থা নেই। যে কারণে করোনার মতো দুর্যোগে শহর বা নগর অঞ্চলের নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। ফলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরকে হটস্পট বানিয়ে বাসা বেঁধেছে করোনা।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা গাজীপুরের শহরাঞ্চলের নাগরিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি দেখভাল করে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা। অথচ সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাতে শিশু টিকাদান কর্মসূচি এবং মাতৃস্বাস্থ্য ছাড়া অন্য কোনো সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। এতে করে এসব অঞ্চলের নাগরিকদের পকেটের পয়সা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয় অথবা শরণাপন্ন হতে হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে রেফার করলেই কেবল ঢাকা মেডিকেল বা এ পর্যায়ের হাসপাতালে নাগরিকদের যাওয়ার কথা ছিল। কেননা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি রেফারেল হাসপাতাল, যেখানে কেবল গুরুতর রোগীদের যাওয়ার কথা। অথচ সেখানে সাধারণ রোগীর ভিড়ই বেশি এবং এসব রোগীর মধ্যে শহুরে দরিদ্রের সংখ্যাই বেশি থাকে।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা গাজীপুরের মতো শহরাঞ্চলের সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে করোনার দুর্যোগে নাগরিকরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাতে যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেগুলোতে আবার প্রয়োজনীয় চিকিৎসক বা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সরঞ্জাম নেই। এসব কেন্দ্রে ভালো মানের চিকিৎসকরাও সচরাচর সেবা দেন না। কারণ সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে একজন চিকিৎসকের ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন- আলাদা হাসপাতাল নয়, সরকারি অবকাঠামো কাজে লাগাতে হবে

চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কৃতি সংগঠক অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যবস্থাপনার দিক থেকে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট সর্বনিম্ন বাজেট। আর্ন্তজাতিক নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ন্যূনতম ৫ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। সরকার বলছে যে দেশের স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ৩ শতাংশ ব্যয় করা হয়। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে জিডিপির মাত্র শূন্য দশকি ৪৭ শতাংশ, যা খুবই অপ্রতুল। এই অর্থ বরাদ্দই প্রমাণ করে, আমাদের স্বাস্থ্য খাত কত গুরুত্বহীন। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য খাতে যতটুকুই বরাদ্দ রয়েছে, তার মাত্র ৩ শতাংশ ব্যয় করা হয় প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়। আমাদের জনগোষ্ঠী বেড়েছে, কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে আমরা এখনো উন্নত হতে পারিনি। পরিচালন সক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই বাজেট, বাজেট বিভাজন, অবকাঠামো, লোকবল— সব জায়গাতেই হাত দিতে হবে।‘

অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি বলেন, ‘আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৪ থেকে ৪০ শতাংশ এখন শহরে বা নগরের বাসিন্দা। অথচ এই নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দেখভাল সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগ করে না, এগুলোর দেখভাল করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার। সরকারের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাকে নগর বা শহরাঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্ব দেওয়া আছে। কিন্তু তারা কতটুকু করে? স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তাদের চিন্তা কী পর্যায়ে, তা আমরা সবাই জানি। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাতে সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। যে কারণে করোনা পরিস্থিতিতে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মতো অঞ্চল করোনা হটস্পটে পরিণত হচ্ছে।’

আরও পড়ুন- দেহে দেহে দুর্গ গড়তে হবে, অ্যান্টিবডি-প্লাজমায় জোর দিতে হবে

লিয়াকত আলি আরও বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমাদেরকে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধ করতে হবে। যেখানে স্বস্থ্যের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, সড়ক যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার, পুলিশ-আর্মি, খাদ্য, ত্রাণ, তথ্যসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রায় সবগুলো মন্ত্রণালয় থাকবে। এসব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধে একটি এক্সিট প্ল্যান করতে হবে। এই এক্সিট প্ল্যানে স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি কৌশল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা এবং কার কী করণীয়— তা উল্লেখ থাকতে হবে। কার কী ভূমিকা থাকবে, উপকমিটির কী কাজ হবে, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ একটি সমন্বিত পরিকল্পনা থাকতে হবে। কেননা এই কোভিড-১৯ নিয়ে আমাদের বহুদিন বাঁচতে হবে এবং লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এর ভ্যাকসিন আসতে আরও দেড় বছরের মতো সময় লাগবে। আর ভ্যাকসিন বের হতে যদি দেড় বছরও লাগে, আমাদের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন বছর। তাই দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।’

বুধবার (২২ এপ্রিল) কোভিড-১৯ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত দেশের ৫৫ জেলায় মোট ৩ হাজার ৭৭২ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই আক্রান্তের হার ৭৩ শতাংশ।

আরও পড়ুন- লকডাউন নয়, সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি

বুলেটিনে আরও জানানো হয়, ঢাকা বিভাগের চার জেলায় আক্রান্তের হার বেশি। নারায়ণগঞ্জে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯৯ জন, যার মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকাতেই আছে ৩৬৪ জন। এই জেলায় এখন পর্যন্ত ৩৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং সুস্থ হয়েছেন ১৬ জন। এছাড়াও গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদীতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।

করোনাভাইরাস করোনার হটস্পট কোভিড-১৯ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর