২ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা চায় তথ্যপ্রযুক্তি খাত
২৩ এপ্রিল ২০২০ ০৯:০৭
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সাধারণ ছুটির আওতায় বলতে গেলে অবরুদ্ধ গোটা দেশ। অর্থনৈতিক খাতগুলোতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। এ পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় তথ্যপ্রযুক্তি খাতও ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গত একমাসে এই খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ কমে গেছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের বিল পাচ্ছে না। অনেকেই হারিয়েছেন ওয়ার্ক অর্ডার। ব্যবসা বন্ধ থাকায় স্বল্প পুঁজির অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ভাড়া ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি আরও কিছুদিন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এই খাতের ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে প্রায় দুই হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবগুলো সংগঠনের পক্ষ থেকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বার্ষিক লেনদেনের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে কম্পিউটার ও প্রযুক্তি পণ্যের বেচাকেনা। তাইওয়ান, হংকংয়ের মতো দেশ থেকে কম্পিউটার পণ্য সরবরাহ করা হলেও এর সবচেয়ে বড় বাজার চীন। দেশের ব্যবসায়ীরা ৯৯ শতাংশ পণ্যই চীন থেকেই আমদানি করে থাকেন। দেশটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর জানুয়ারি থেকেই পণ্য আমদানি কমতে থাকে। মার্চ থেকে পণ্য আসা একেবারেই বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় অনেক ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। একে বড় ধরনের লোকসান হিসেবে দেখছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি মো. শাহিদ উল মুনীর সারাবাংলাকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি বিপণন কেন্দ্র, হাইটেক পার্ক, জনতা সফটওয়্যার পার্কসহ বিভিন্ন স্থানের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দম ফেলার ফুসরত পাচ্ছিল না, তখন হঠাৎ করেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ স্থবির হয়ে গেল। চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকেই সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়। তখন থেকেই প্রভাব পড়তে শুরু করে এই খাতে। এর মধ্যে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মার্কেট বন্ধ থাকায় সব ধরনের হার্ডওয়্যার পণ্যের বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে প্রতিমাসে দেশে মোবাইল ফোনসহ ১২শ টাকার যে হার্ডওয়্যার পণ্য বিক্রি হতো, সেই বিক্রি একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে।
বিসিএস সভাপতি জানান, তাদের সংগঠনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট কর্মী ৬০ হাজারের বেশি। এর বাইরে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে জড়িত দেশের ১০ লাখ মানুষ। চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ব্যবসায় সংকট দেখা দেবে।
শাহিদ উল মুনীর বলেন, এ খাতে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করতে হয়। তাদের পেছনে বিনিয়োগ করার কারণে তাদের ছাটাই করলেও লোকসান, আবার ধরে রাখাও কঠিন। সরকারের সহযোগিতা না পেলে এই সংকট দূর করে আগের স্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ৬৮০ কোটি টাকা সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
কেবল হার্ডওয়্যার নয়, সফটওয়্যার খাতের কার্যক্রমও বন্ধ প্রায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কল সেন্টারগুলোতে কাজ তিন ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। খুব অল্প কিছু ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানই চালু আছে। ইউরোপ-আমেরিকা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংও স্থিমিত। তবে জরুরি সেবা হিসেবে চালু রয়েছে টেলিযোগাযোগ খাত, ইন্টারনেট সেবা।
হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে যে সংকটের মধ্যে তারা পড়েছেন, তা কাটিয়ে উঠতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার পুঁজির প্রয়োজন হবে। বিসিএসের চাহিদার ৬৮০ কোটি টাকাসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সংগঠনগুলো মিলে এক হাজার ৯৩০ কোটি টাকা সরকারের কাছে আর্থিক অনুদান চেয়ে চিঠি লিখেছে। এরই মধ্যে সে চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনগুলোর নেতারা বলেছেন, বিশ্ব বাজারে তাদের কাজের পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। স্থানীয় বাজারেও একই পরিস্থিতি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে তাদের বিপুলসংখ্যক জনবলের বেতন, অফিস ভাড়া, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এ অবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনসহ প্রযুক্তি খাতে কর্মরতদের আগামী ছয় মাসের আংশিক বেতন ও অফিস ভাড়া পরিশোধ করে ব্যবসা সচল রাখতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য কেবল বেতন বাবদ ১৫৬০ কোটি টাকা এবং অফিস, শো-রুম বা ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ ৩৭০ কোটি টাকাসহ মোট ১৯৩০ কোটি টাকা অনুদান চাওয়া হয়েছে সরকারের কাছ থেকে। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ৫ বছর মেয়াদি ২ শতাংশ সুদে জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতেও অনুরোধ করা হয়েছে সরকারকে।
সফটওয়্যার ও আইটি সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, বিদেশি বাজারে যারা কাজ করতেন, তাদের ৮০ ভাগ কাজ এখন বন্ধ। স্থানীয় বাজারেরও ৫০ ভাগ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন করে কেউ অর্ডার নিচ্ছে না। বাইরের ওয়ার্ক অর্ডারও বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে এ খাতে অনুদান না পেলে ছোটখাটো সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর টিকে থাকা কঠিন হবে। যারা টিকে থাকবে, তাদের কাজের পরিধি কমিয়ে আনতে হবে। সেখানে দক্ষ কর্মীরও সংকট দেখা দেবে।
আলমাস কবির বলেন, আমরা সরকারের কাছে দুই শতাংশ হারে সরল সুদে জামানতবিহীন ঋণ চেয়েছি। প্রথম এক বছর গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে চেয়েছি। এই অর্থ সুবিধা পেলে আমরা সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।
বেসিস সভাপতি আরও বলেন, ই-কমার্স ও ডিজিটাল ট্রানজেকশনের একটি উজ্জল ভবিষ্যৎ রয়েছে। দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পর বাইরের অনেকগুলো দেশে হয়তো তাদের নতুন নতুন সার্ভিস শুরু করবে। আমরা প্রস্তুত থাকলে সেখানে আমরা তাদের অফার করতে পারি। তখন বাইরের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বেশ কিছু সংগঠন দুই হাজার কোটি টাকার মতো আর্থিক সহায়তা চেয়েছে। তাদের দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরব। তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন আশা করি।