‘শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনীতি— দু’টোই বিবেচনায় নিতে হবে’
২৩ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৫২
ঢাকা: করোনভাইরাসের কারণে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প সাধারণ ছুটির সময় খোলা রাখা হবে কি না, সে বিষয়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকেও বিবেচনায় নিতে আহ্বান জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত সতর্কতার সঙ্গে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হবে। তেমনি দেশের অর্থনীতিও বিবেচনায় নিতে হবে। ভিয়েতনাম ও চীন তাদের কারখানা খুলে দিয়ছে। অনেক উন্নত দেশও লকডাউন থেকে বের হয়ে আসছে। সবদিক বিবেচনা করেই আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) সিপিডি’র উদ্যোগে ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সপ্তম বার্ষিকী – কোভিড-১৯: সংকটের মুখে শ্রমিক ও মালিক, সরকারি উদ্যোগ ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এসব বক্তব্য উঠে আসে সিপিডি‘র পক্ষ থেকে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের উপস্থাপনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিডি‘র সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। সভায় মূল গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সিপিডি‘র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আলোচনায় অংশ নেন বিজিএমইএ‘র সহসভাপতি আরশাদ জামান দিপু, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের (এনজিডব্লিউএফ) সভাপতি মো. আমিরুল হক আমিন, শ্রমিক নেতা নাজমা আকতার, জলি তালুকদার, তাসলিমা আকতারসহ অন্যরা।
সিপিডি‘র সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ অত্যান্ত কঠিন সময় পার করছে। আমরা জানি না আগামী দিনগুলোতে কী হবে। এ অবস্থায় আমাদের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, দেশের অর্থনীতি— সবকিছুই মানবিকভাবে বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, সাধারণ ছুটির সময় রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প স্বল্পপরিসরে চালু করা হবে কি হবে না, চালু হলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি কিভাবে মোকাবেলা করা যায়— এসব বিষয় ভাবতে হবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির কথাও আমাদের ভাবতে হবে। এরই মধ্যে চীন ও ভিয়েতনাম তাদের কলকারখানা খুলে দিয়েছে। অনেক উন্নত দেশে ধীরে ধীরে লকডাউন থেকে বের হয়ে আসছে। তাই আমাদের কারখানা না খুললে অনেক অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে, যা এই খাতের টিকে থাকার জন্য ঝুঁকির কারণ হবে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, কারখানা চালু করলে আমরা কিভাবে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করব, সেটা সবাই মিলে ভাবতে হবে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভুল করা যাবে না। অর্থনীতি ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি— উভয় বিষয় নিয়েই ভাবতে হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, শ্রমিক উদ্যোক্তা, ব্র্যান্ড, বায়ার ও সরকার— প্রত্যেকের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তা, খাদ্যের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যর নিরাপত্তাগুলো আগে নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, উদ্যেক্তারা যে রফতানি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন, সে বিষয়ে ব্র্যান্ড ও বায়ারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বণ্টন করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।
মূল প্রবন্ধে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মার্চ মাসে দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। চলতি এপ্রিল মাসে সেটা আরও কমে যাবে। পোশাক খাতের ক্রেতারা ৩১৬ কোটি মার্কিন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছিল। পরে আবার ১৪টি ব্র্যান্ডের মাধ্যমে একশ কোটি ডলারের অর্ডার ফেরত আসে।
তিনি বলেন, যেসব অর্ডাল বাতিল হয়েছে, সেসব অর্ডারের বিপরীতে অনেক গার্মেন্টস মালিক প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনে উৎপাদনও শুরু করেছিলেন। ফলে এ অবস্থায় অর্ডার বাতিল কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই বিষয়টি বাংলাদেশ আইসিসি‘র কাছে উপস্থাপন করতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, পোশাক কারখানা খোলা রাখা নিয়ে স্বাস্থ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। তবে কারখানা খোলা রাখতে চাইলে শ্রমিকদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ চাকরি হারোনো কিংবা বেতন না পাওয়ার অতঙ্কে রয়েছেন। মালিক, উদ্যোক্তা ও বায়ারদেরই এই অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। পাশাপাশি আগামী ছয় মাসের জন্য তাদের ন্যূনতম খাদ্য সুবিধা নিশ্চিত করতেও মালিক, বায়ার ব্র্যান্ড ও সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময়কার কথা উল্লেখ করে সিপিডি‘র এই গবেষণা পরিচালক বলেন, রানা প্লাজা ধসের সময় মালিক-শ্রমিক-ব্র্যান্ড-বায়ার ও সরকারের সহযোগিতার মনোভাব গড়ে উঠেছিল। এখন সেটাই অনুসরণ করা উচিত। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতে কর্মপরিবেশ, বেতন ও নিরাপত্তাসহ সার্বিকভাবে পরিবেশের যে উন্নতি হয়েছিল, করোনা সংকটের কারণে তা আবার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
আলোচনায় বিজিএমইএ‘র সহসভাপতি আরশাদ জামান দিপু বলেন, এরই মধ্যে ৯৭ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের বেতন দিয়েছে। আগামী মাসে কারখানা খুলে দিলে কিভাবে উৎপাদন চলবে, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। কারণ অনেক কারখানার অর্ডার না থাকার কারণে উৎপাদনে যেতে পারবে না। অবার কোনো কোনো কারখানায় কিছু অর্ডার থাকলেও কাঁচামালের সংকট রয়েছে।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে বর্তমানে এক থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করে— এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। এসব প্রতিষ্ঠানে দেড় কোটি শ্রমিক কাজ করছে। তাদের আলাদাভাবে এক হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া দরকার।
জলি তালুকদার বলেন, ৪০ বছরের একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান কিভাবে দুই-তিন মাসও নিজস্ব ফান্ড থেকে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে না, এটা বোধগম্য নয়। কারখানা বন্ধ থাকার প্রথম মাসেই কেন সরকারের তহবিলের টাকা দিয়ে বেতন দিতে হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
তাসলিমা আকতার বলেন, রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির পর অনেক আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো অনেক আহত শ্রমিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না, অনেক শ্রমিক এককালীন টাকা পাননি। পোশাক কারখানার মালিকরা অনেক প্রতিশ্রুতিই দেন, কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি আর পরে মনে রাখেন না।
কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত পোশাক কারখানা পোশাক খাত সাধারণ ছুটি সিপিডি