মধ্যবিত্তের চাপা কান্না দেখছে না কেউ
২৪ এপ্রিল ২০২০ ১৭:৩১
ঢাকা: মহামারি করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় সরকারি নির্দেশে ঘরে অবস্থান করছে মানুষ। এই সময়ে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত। করোনার ছোবলে থমকে গেছে গোটা বিশ্ব। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশেও। লকডাউন হচ্ছে একটার পর একটা জেলা। এই পরিস্থিতিতে উচ্চবিত্তদের আরাম আয়েশে দিন কাটলেও নগর জীবনে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের দিন কাটছে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে।
এরমধ্যে অনেক ব্যক্তি-সংগঠনের পক্ষ থেকে অসহায়, অসচ্ছলদের পাশে দাঁড়ালেও মধ্যবিত্তদের দু চোখে যেন ঘোর অন্ধকার। চরম অসুবিধায় থাকলেও কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। লোকলজ্জার ভয়ে তারা নীরবে-নিভৃতে চাপা স্বরে কাঁদছেন। তা দেখা বা বোঝার যেন কেউ নেই। রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন পেশার পাঁচ পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই উঠে এসেছে।
ফুটপাতে টি-শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি বিক্রি করতেন নুরুল আমিন (৫০)। এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ পাচঁজনের সংসার নুরুল আমিনের। মহামারি করোনা ভাইরাসের কারনে প্রায় মাসখানিক ধরে বন্ধ তার ফুটপাতের দোকান। লকডাউনের এ সময় আত্মীয় স্বজন থেকে কিছু সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে একমাস সংসার টেনে টুনে চালালেও সামনের দিনগুলোতে অন্ধকার দেখছেন তিনি। জমানো টাকা যা ছিল তাও শেষ। এ অবস্থায় কী করবেন, কী করা উচিত, ভেবে উঠতে পারছেন না তিনি। সংসার চালাতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। চক্ষু লজ্জায় কষ্টগুলো প্রকাশও করতে পারছেন না।
নুরুল আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার থেকে বড় ভয় হচ্ছে না খেয়ে মরার ভয়। আয় রোজগার নাই। একমাস ধরে বেচা বিক্রি বন্ধ। এখন তো ঘরেই বন্দি। দুইমাসের ঘর ভাড়া বাকি পড়েছে। আত্মীয় স্বজনের কিছু সহযোগিতায় খাবার জুটলেও সামনের দিনগুলো কী করব বুঝতে পারছি না।’
আইনজীবীর সহকারী হিসেবে সুপ্রিমকোর্টে কাজ করেন শারমিন আক্তার (২৪)। বেতনভুক্ত নন তিনি। দৈনন্দিন মামলা অনুযায়ী তার আয়। কোর্ট বন্ধ এ কারণে তার আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য সময় যখন কোর্ট ছুটিতে থাকে, তখন ভ্যাকেশন কোর্ট থাকে। সে সময় অল্প হলেও মামলা থাকে। আয় একেবারে ব্ন্ধ হয় না। কিন্তু গত ২৬ মার্চ থেকে কোর্ট সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। দীর্ঘ দিন আয় রোজগার না থাকায় খুব কষ্টে দিন যাপন করছেন শারমিন ও তার পরিবার।
বাসাবো এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত, কোনো সাহায্যও পাই না। কারও কাছে বলতেও পারি না। অনেক কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছি। এ অবস্থা কতদিন চলবে তাও জানি না। কয়েকদিন আগে গত মাসের ঘর ভাড়া দিয়েছি। এখন হাত খালি হয়ে আসছে। সামনে মাসে কী করব জানি না।’
শারমিন বলেন, ‘আমরা আইনজীবীর সহকারীরা সব থেকে বেশি কষ্টে আছি। আমাদের পেশার আইনি স্বীকৃতির দাবিও সরকার পূরণ করছে না। সরকার থেকে আমরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমাদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন ভাতা নেই। এভাবে দীর্ঘদিন কোর্ট বন্ধ থাকলে আমরা আরও বেশি বিপদে পড়ব।’
কসমেটিক দোকানদার আব্দুস সাত্তার (৩০)। এই দোকানই তার একমাত্র আয়ের উৎস। এক মাস ধরে দোকান সম্পূর্ণ বন্ধ। ১ বৈশাখ সামনে রেখে হাতের জমানো টাকা দিয়ে দোকানে নতুন মাল উঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বেচা বিক্রি শুরু হওয়ার আগেই করোনার ছোবলে সব বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় আয় রোজগার তো একেবারেই বন্ধ। হাতে যা ছিল তা দিয়েও মাল কিনে দোকানে ওঠানো হয়েছে। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
সারাবাংলাকে এ দোকানি বলেন, ‘বৈশাখ আর ঈদকে সামনে রেখে হাতে যা ছিল টাকা পয়সা তা দিয়ে মাল কিনে দোকানে তুলেছি। এরপর থেকেই করোনার প্রভাবে বেচা বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। আয় তো নাই, বরং সংসার চালাতে যা ছিল তাও হাতে নাই। এখন কোনো রকম করে চলতেছি। এ অবস্থায় তো কেউ ধার দেনাও দেয় না। না খেয়ে মরে গেলেও কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারি না। সরকার যদি আমাদের কোনোভাবে সহযোগিতা করত তাহলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারতাম।’
অনলাইনে অর্ডার করলে বাসায় খাবার পৌঁছে দিত রাব্বি। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের খাবার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে রাব্বির আয় উপার্জনও। ঢাকায় লেখাপড়ার পাশাপাশি হোম ডেলিভারি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা রাব্বি জানান, দীর্ঘদিন ধরে কোনো আয় নাই। হাতে যা ছিল তাও প্রায় শেষ। এই কারণে তিনি সাইকেল নিয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালে যেতে চেয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, একটি জুতার শো-রুমে চাকরি করেন তিনি। এক মেয়েও স্ত্রীসহ তিনজনে ভালোই ছিলেন। করোনার প্রাদুর্ভাবে শো-রুম বন্ধ। বেতনও বন্ধ। হাতে কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে কিছু বাজার করেছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে কঠিন অনিশ্চয়তায় পড়ে অন্ধকার দেখছেন চোখেমুখে।
প্রাইভেট একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন রাহানুর বেগম (৪০)। মার্চের ১৫ তারিখ থেকে স্কুলটি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পেলেও মার্চ ও এপ্রিলের বেতনের কোনো সম্ভাবনাও নাই। তিন বেলার খাবার এখন দুই বেলা করে খেয়ে কোন রকম বেঁচে আছে রাহানুর বেগমের পরিবার। শিগগিরিই এ পরিস্থিতি কেটে না গেলে সামনের দিনগুলো তার জন্য ভয়াবহ।
রাহানুর বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি একটা প্রাইভেট স্কুলের মর্নিং শিফটের একজন শিক্ষিকা। অনেক কম বেতনে চাকরি করি। স্বামী কাজকর্ম করতে পারেন না, অসুস্থ। আমার বেতন ও মেয়ের টিউশনির টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। একমাস ধরে স্কুল ছুটি থাকায় বেতন হয় না। টিউশনিও নেই। টাকা-পয়সা নেই। মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছি। এ অবস্থায় বিত্তশালীরা আমাদের মধ্যবিত্তের পাশে এগিয়ে না এলে আমরা বিপদে পড়ব আরও বেশি।’
অচিরেই সবাই যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন এই প্রার্থনা জানান তিনি। একইসঙ্গে বাসা-ভাড়া মওকুফ করতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
করোনা মোকবিলা করোনাভাইরাস ত্রাণ মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবার সরকারি সহায়তা