Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রযুক্তির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর মনিটরিং চান চিকিৎসকরা


২৫ এপ্রিল ২০২০ ০৮:১৫

ঢাকা: বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতিকে দেশব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যদিও এই ভাইরাসে সৃষ্টি পরিস্থিতিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে অনেক আগেই। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে দেশকে ‘লকডাউন’-এ রাখার মধ্য দিয়ে ভাইরাসটির বিস্তার রোধের চেষ্টা করছে সরকার। পাশাপাশি কয়েকটি হাসপাতালকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড ঘোষণা করে চিকিৎসা যন্ত্রপাতিসহ চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুত করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

যদিও বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের আগে থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, ‘কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত’। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, চিকিৎসার জন্য  আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) অপ্রতুলতা। এছাড়া হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে পিপিই সরবরাহ করা হলেও সেগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেও শোনা যাচ্ছে নানা রকম অভিযোগ।

বিজ্ঞাপন

দেশে যখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তখন এমন সমন্বয়হীনতার চিত্র বেরিয়ে আসছে। এমনকি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বক্তব্যের সঙ্গে মিলছে না মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চিকিৎসকরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান; যাতে করে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সব সমস্যার কথা চিকিৎসকরা প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেন। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রযুক্তির সহায়তা চাইলেই এটা করা সম্ভব। যেখানে বিভিন্ন উপায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সরাসরি কোভিড-১৯ এর জন্য বরাদ্দকৃত হাসপাতালগুলো মনিটরিং করা যাবে। আর এতে করে গতি পাবে করোনা চিকিৎসা।

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) করোনা আক্রান্তদের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ওই মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তার অবস্থার অবনতি হলেও তাকে সেখানে আইসিইউ সার্পোট দেওয়া যায়নি। কারণ আইসিইউ ইউনিটে থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ছিল না বলে জানান সেই হাসপাতালেরই আরেকজন চিকিৎসক। পরে ডা. মঈন গত ১৫ এপ্রিল ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল। ফেব্রুয়ারিতে করোনা চিকিৎসায় এই হাসপাতালের নাম ঘোষণা করা হলেও দেখা যায় এপ্রিলেও সেটি পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। হাসপাতালে ছিল না পোর্টেবল এক্সরে মেশিন, এবিজি বা সিটি স্ক্যান। এখনও হাসপাতালটিতে নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা। যদিও প্রথম দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর এসব অস্বীকার করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সারাবাংলা ডটনেটসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। একই অবস্থা অন্যান্য হাসপাতালেরও। সম্প্রতি আলোচনায় আসা মহানগর হাসপাতালের নিম্নমানের পিপিই নিয়ে তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই সমালোচনা করেছেন। এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এমনকি চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও উঠছে নানা ধরনের প্রশ্ন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতকরণে প্রযুক্তির ব্যবহারকে আমরা সব সময়ই স্বাগত জানাই। আমরা এক্ষেত্রে বলি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি সরাসরি চিকিৎসা ব্যবস্থা মনিটরিং করেন তবে সেবার মান বাড়বে। আর কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থাও গতি পাবে। এতে সাধারণ মানুষের কাছে পুরো বিষয়টি হবে বিশ্বাসযোগ্য এবং আস্থা ফিরে পাবেন তারা। যে মানুষটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন তিনি যদি জানেন যে, তার সেবা পাওয়ার বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই মনিটর করা হচ্ছে তবে তিনি স্বস্তি পাবেন। পাশাপাশি আমাদের চিকিৎসকরাও নিরাপত্তার বলয়ে থাকবেন। উনাদের মনোবলও তখন বেড়ে যাবে বহুগুণ।’

তিনি বলেন, ‘এটি আসলে প্রয়োজন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মনিটরিং করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেই সরাসরি এই কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। তিনি এমনিতেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারপরেও যদি কখনো সময় পান তবে যেকোনো হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের সমস্যার কথা শুনতে পারবেন। সেইসঙ্গে রোগীরাও কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাও তিনি জেনে নিতে পারবেন। আর এতে করে কিন্তু দেশেরই লাভ। যারা দায়িত্বে আছেন তখন তারাও সতর্ক হয়ে উঠবেন।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এনআইসিভিডি ডা. আশরাফুল হক সিয়াম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দেশের সবকিছু নিয়েই ভাবছেন। বর্তমানে কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থা উনি যখন থেকে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছেন তখন থেকে কাজে গতি পেয়েছে- এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। উনার সার্বক্ষণিক দেশের জন্যেই কাজ করে যান। এত ব্যস্ততার মাঝেও যদি উনি কিছুটা সময় নিয়ে হাসপাতালগুলোর অবস্থা নিজে মনিটর করেন এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন তবে বর্তমান অবস্থা আরও গতি পাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় অনেক সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে যদি প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করা যায় তবে তা অবশ্যই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে।’

হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে সরাসরি মনিটরিং করা সম্ভব বলে জানান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) পরিচালক দিদারুল আলম সানি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা খুবই সহজ একটি বিষয়, যা চাইলেই করা যায়। এর জন্য আইপি সেটআপ নিয়েই করা যায়। নরমালি সিসি ক্যামেরা দিয়ে মনিটরিং করলে অনেক সময় দেখা যায়, আপনি সমস্যার বিষয়ে জানাতে পারছেন না। এক্ষেত্রে লাইন রোবট ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরুন হাসপাতালে পাঁচটা লাইন আছে। এক্ষেত্রে রোবট সরাসরি নিজে থেকেই যেতে পারবে রোগীর কাছে। সেই রোবটে থাকবে ক্যামেরা ও কথা রেকর্ড করার প্রযুক্তিও। ক্যামেরা দিয়ে মনিটর করা যাবে এবং এই প্রক্রিয়ায় চাইলেই আপনি পুরো হাসপাতালেই কাভার করতে পারবেন। এক্ষেত্রে রোগীর বা চিকিৎসকের যদি কোনো অভিযোগ থাকে তবে তা ভয়েস কমান্ড দিয়ে সেটা জানাতে পারবে। সেই অভিযোগ একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং ইউনিট বা কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে যাবে। সেগুলো থেকে মনিটরিংয়ে থাকা দল একটা সামারাইজ রিপোর্ট নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিতে পারবেন। এতে করে অথেনটিসিটি ও ট্রান্সপারেন্সি দুটোই বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র কোভিড-১৯ হাসপাতালগুলোতেও যদি এই ব্যবস্থা করা যায় তবে তা অনেক কার্যকর হতে পারে। আমাদের দেশেই বর্তমানে এই প্রযুক্তি আছে। প্রধানমন্ত্রী যদি সরাসরি কেস টু কেস দেখতে চান তবে সেটাও সম্ভব। এক্ষেত্রে ডেটা কানেকশানের মাধ্যমে অ্যামাজান ইকোর আইওটি বেইজ ক্যামেরা প্রযুক্তি দিয়েও মনিটর করা যায়। এসব প্রযুক্তি সহজলভ্য। চাইলেই এগুলো ব্যবহার করা যায়। এগুলোর চেয়েও আধুনিক প্রযুক্তি হলো- অ্যামাজান ইকো ও লাইন রোবট। এগুলোর সঙ্গে ম্যাপিং করে নিলে আরও ভালো কাজ করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে যদি সব মনিটরিং করা হয় তবে সম্প্রতি পিপিই বা চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবাই সরাসরি জবাবদিহিতার আওতায় চলে আসবে।‘যদি সিসি ক্যামেরা বেইজ কিছু ব্যবহার করতে হয় তবে ৮ থেকে ১০ দিন ও লাইন রোবোটিক সিস্টেম করতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগতে পারে বলে জানান বেসিসের এই পরিচালক।

এদিকে বিএসএমএমইউ’র মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন। চিকিৎসকদের যে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে সেটাও উনাকে জানানো হয়েছে। সেগুলো নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন। আর তাই তিনি নিজেই এখন বিভিন্ন কনফারেন্সে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন। উনার তত্ত্বাবধানে এখন কাজে কিছুটা গতি পেয়েছে। এক্ষেত্রে যদি প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা যায় তবে কোভিড-১৯ চিকিৎসা দ্রুত গতি পাবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর