‘রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের ৫৭ শতাংশ কর্মহীন’
২৬ এপ্রিল ২০২০ ১২:৫২
ঢাকা: রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ এখনও কর্মহীন। গত কয়েক বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ পোশাক শ্রমিকের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটেছে। শারিরীক ও মানসিক ভাবে দুর্বল অনেকেই। এখনও অনেকের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা কাজ করে।
এ দিকে রানা প্লাজা ট্রাস্ট তহবিলে পড়ে আছে ৮ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে কর্মহীনদের জীবনমানের অনেকটাই পরিবর্তন করা সম্ভব বলে মনে করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড।
শনিবার (২৫ এপ্রিল) বেরসকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘সপ্তম বর্ষে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা এবং কোভিড-১৯’ শীর্ষক এক অনলাইন ডায়ালগে এ সব তথ্য তুলে ধরা হয়।
ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি’র সাত বছর পূর্ণ হয়েছে শুক্রবার (২৪ এপ্রিল )। দিবসটিকে সামনে রেখে এই অনলাইন ডায়ালগের আয়োজন করে একশনএইড। ক্ষতিগ্রস্ত ২০০ জন পোশাক শ্রমিকের ওপর মোবাইল ফোন কলের মাধ্যমে পরিচালিত জরিপের তথ্য এতে উপস্থাপন করা হয়।
একশনএইড বলছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ এখনও কর্মহীন। তবে তারা একেবারেই কর্মহীন থাকেন না, কিন্তু বছরের বিভিন্ন সময়ে শারীরীক দুর্বলতা এবং নানা সমস্যার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েন।
জরিপে দেখা গেছে, যে সকল ভুক্তভোগী এখন কর্মরত রয়েছেন, তাদের মধ্যে ১২ শতাংশই পোশাক কারখানায় রয়েছেন।
এ বছরের জরিপে পাওয়া গেছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ পোশাক শ্রমিকের স্বাস্থ্যে অবনতি হচ্ছে। তারা মূলত তীব্র মাথা ব্যথা, হাত-পায়ের ব্যথা ও অসাড়তা এবং মেরুদণ্ডের ব্যথাকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিকে ৫৮.৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে তারা মোটামুটি সুস্থ আছেন এবং ২৭.৫ শতাংশ নিশ্চিত করেছেন যে তারা পুরোপুরি সুস্থ আছেন। মানসিক স্বাস্থ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ বছর ১২.৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা এখনও স্বাভাবিক নয়। এখনও অনেকের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা কাজ করে।
অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিডি ডায়ালগ (সিপিডি)’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের ১০ শতাংশ এখনও নানা দুর্দশায় আছে। তারা তাদের ওই অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না। রানা প্লাজা ট্রাস্টে ৮ কোটি টাকা রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের উচিৎ এই ট্রাস্টের টাকা দিয়ে আহতদের আরেক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া। যেন ১৪ শতাংশ শ্রমিক তাদের সাধারণ জীবনে ফিরতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের জোর করে কর্মক্ষেত্রে না আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের জোর করে না আনার ক্ষেত্রে মালিকদের ভূমিকা রাখতে হবে। নতুবা করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার আরও বেশি শঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্রান্ড বায়ারদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। এই সময়ে তারা যেন পণ্য পাঠানোর জন্য চাপ না দেয়। সরকার শ্রমিকদের ৩ তিন মাসের বেতনের একটা ব্যবস্থা করেছে। এটি হয়তো চলতে পারে। তবে অবস্থা দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার শঙ্কা থাকায় মালিকও ও ব্রান্ড-বায়ারদের এগিয়ে আসতে হবে। অন্তত আরও ৬ মাস যাতে শ্রমিক বেতন পায় সে ব্যাপারে একটি উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।’
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘৭ বছরেও দেশের পোশাক খাতে সুশাসনে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আইনের বাস্তবায় ঘটলে মালিকরা পার পেয়ে যেত না। প্রয়োগ না হওয়ায় মালিকরা আইনকে ভয়ও পায় না। সবকিছুতে দায়ী হল আইনের বাস্তবায়ন নেই। করেনার সময়েও আমাদের শ্রমিকদের টেনে হিঁচড়ে মেশিনের মতো নিয়ে এসেছে। এখন পর্যন্ত অনেক শ্রমিক মার্চ মাসের বেতন পায়নি। আমাদের অবদানের কথা কেউ কেন স্মরণ রাখে না। কেউ কেন মনে রাখে না। এখন আবার লে-অফ করে দিছে। এতে ১০ শতাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। মালিকরা এখন আবার ফ্যাক্টরি খোলার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এখনও অনেক ফ্যাক্টরি খোলা আছে। ফ্যাক্টরিতে সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।’
আইএলও- বাংলাদেশ অফিসের কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমা পতিয়াইনেন বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই প্রতিটি দেশে সরকারের সঙ্গে আমাদের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিই অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তারা কি ধরনের সমস্যায় আছেন, সেটা জানতে হবে এবং সমাধানও করতে হবে। শুধু অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে কারখানা খোলার চিন্তা করলেই হবে। সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আর এই বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার আওতাভুক্ত হওয়া উচিত।’
একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘শ্রমিকদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে মালিক পক্ষ, শ্রমিক পক্ষ, অর্থনীতিবিদ এবং সচেতন নাগরিকদের নিয়ে একটি পরিকল্পনা দল তৈরি করতে হবে। যেখান থেকে সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হবে। তথ্যের ভ্রান্তির কারণে শ্রমিকদের যাতে ভোগান্তি না হয়। যারা কারখানা খোলা রাখতে চাচ্ছেন তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে হবে যে, কারাখানা খোলা হলে তারা শ্রমিকদের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর ফলে যদি কোন সুযোগ তৈরি হয় তাহলে সেটা হতে হবে শ্রমিক বান্ধব। আমরা এখন মধ্য আয়ের দেশ। তাহলে কেন আমরা শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে পারি না। শ্রমিকদের খাদ্য, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এবং ভাবতে হবে যে, দিন শেষে যদি অর্থনীতি যদি আগের মতো না হয় তাহলে এই শ্রমিকদের বিকল্প জীবিকা কি হবে। সামনের আর্থ-সামাজিক দুর্যোগ আমরা কিভাবে মোকাবিলা করবো সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।’
অনুষ্ঠানে তুলে ধরা একশনএইডের পরামর্শগুলো হল- রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ভুক্তভোগীসহ সকল শ্রমিকদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে মৌলিক চাহিদাসমূহ পুরণের নিমিত্তে খাদ্য এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করা এবং বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা। ভবিষ্যতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুর্যোগকালীন সংকটের আশঙ্কা নজরে রেখে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার টাকা কিভাবে ব্যবহার হবে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা খুব জরুরি। শ্রমিকদের জীবন যাত্রায় ভোগান্তি দূরীকরণে রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং তাদের সংগঠন বিজেএমইএ এবং বিকেএমইএসহ সকল নাগরিক সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্র্যান্ড এবং বায়ারদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের সরবরাহকারী কারখানাগুলি যেন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কারখানাগুলোর স্থগিতকরণ সম্পর্কিত সরকারি সুপারিশগুলো অনুসরণ করে, সকল শ্রমিকের চুক্তি বজায় রাখে এবং তাদের সম্পূর্ণ মজুরি নিয়মিত প্রদান করে। ভবিষ্যতে আহত, কর্মক্ষমতা বা চাকরি হারানো শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ সামাজিক বীমার আওতায় আনা প্রয়োজন। এ জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহন করে এটি বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি।
অনুষ্ঠানে আরও যুক্ত ছিলেন আইন ও শালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন ড. হামিদা হোসেন ও সাংবাদিক সালাউদ্দিন বাবলু।
একশনএইড কর্মহীন শ্রমিক বেকার রানা প্লাজা রানা প্লাজার শ্রমিক