‘পঙ্গপাল নিয়ে শঙ্কা নেই, ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ভিত্তিহীন’
২৮ এপ্রিল ২০২০ ১০:০০
ঢাকা: আফ্রিকা মহাদেশের কৃষিজমিতে তাণ্ডব চালিয়ে এবার দক্ষিণ এশিয়ার দিকে ধেয়ে আসছে পঙ্গপালের দুটি ঝাঁক। এরই মধ্যে একটি ঝাঁক পাকিস্তান হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। আরেকটি ঝাঁক ভারত মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে। ভারতের কৃষিজমিতে হানা দেওয়ার পর এরা বাংলাদেশের দিকে আসতে পারে বলে জানাচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দু। তবে শস্যখেকো পতঙ্গ পঙ্গপাল বাংলাদেশে হানা দেওয়ার শঙ্কা দেখছেন না কৃষি সংশ্লিষ্ট কেউ। এমনকি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, এখানে পতঙ্গটির আক্রমণের ঝুঁকিও নেই।
‘বাংলাদেশে পঙ্গপাল হানা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে’- সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্বাপর সময়ে ভারত ও পাকিস্তানে ফড়িং গোত্রের এই পতঙ্গের আক্রমণ ঘটলেও তখন বাংলাদেশে তা ছড়ায়নি। বিগত ৫০ বছরেও এমনটি ঘটেনি। কারণ দেশের আবহাওয়াই পঙ্গপাল বিরোধী।
সোমবার (২৭ এপ্রিল) কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি কয়েকটি পত্রিকায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পঙ্গপাল ঢুকে পড়বে। এটি আমাদের নজরে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, পঙ্গপালগুলো ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে বাংলাদেশে হানা দেবে। এই কথার কোন ভিত্তি নেই। বাংলাদেশে পঙ্গপাল হানা দেওয়ার শঙ্কা দেখছি না।’
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলার কারণ ব্যাখ্যা করে কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি তাদের মূল প্রতিবেদনটিও দেখেছি। সেখানে এমন কথা উল্লেখ আছে, ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে পঙ্গপাল হানা দেবে। ভারত মহাসাগর অতিক্রম করতে হলে তাদের উৎপত্তিস্থল হতে হবে ফিলিপাইন অথবা সিঙ্গাপুর। কিন্তু এই পতঙ্গপালের আসার কথা আফ্রিকা বা সৌদি আরব থেকে। আর আফ্রিকা থেকে আসতে হলে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ তাদের প্রতিবেদনের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।’
নাসিরুজ্জামান আরও বলেন, ‘ভারতে পঙ্গপাল হানা দিলেও সেটা বাংলাদেশে আসবে না। কারণ পঙ্গপাল ব্রিডিং করতে করতে এগিয়ে আসা। তা করতে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন। ব্রিডিং করতে হলে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির উপরে থাকতে হবে। বাংলাদেশের তাপমাত্রা সবসময় এর চেয়ে কম থাকে। আবার ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে আদ্রতা হতে হবে ৫০ ডিগ্রির নিচে, বাংলাদেশে এটি বেশিরভাগ সময় ৭০ ডিগ্রির ওপরে থাকে। দেশের আবহাওয়া মরুভূমির মতো না হওয়ায় এখানে পঙ্গপাল হানা দেওয়ার কোন শঙ্কা আমরা দেখছি না। আমরা আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, দেশের আবহাওয়াই পঙ্গপাল বিরোধী।’
এর আগে মার্চে সারাবাংলাকে তিনি বলেছিলেন,‘আমাদের দেশে যে ঘাস ফড়িং আছে পঙ্গপাল তারই একটি জাত। ঘাস ফড়িং একা থাকতে পছন্দ করে। আর পঙ্গপাল দল বেঁধে এগিয়ে যেতে যেতে ব্রিডিং (প্রজনন) করে। পঙ্গপাল মূলত মরুভূমির প্রাণী। এরা উষ্ণ আবহওয়া ছাড়া জন্মায় না। গত ৫০ বছরেও বাংলাদেশে এর আক্রমণ হয়নি। এরা এখন যে এলাকায় আছে, আগেও সেখানে আক্রমণ হয়েছে। পাকিস্তান ও রাজস্থানে আগেও পঙ্গপালের আক্রমণ ঘটেছে। তখন কিন্তু বাংলাদেশে আক্রমণ হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশে পঙ্গপালের আক্রমণ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।’
কোন কারণে আক্রমণ দেখা দিলে কী হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পঙ্গপালের আক্রমণ ঠেকানোর অস্ত্র বিশ্বে নেই। খুব একটা কার্যকর কোন পন্থাও নেই। তবে আমাদের আবহওয়ায়টাই পঙ্গপাল বিরোধী। প্রকৃতিই আমাদের সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহকারী রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. নূর আহমেদ খন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে পঙ্গপালের আক্রমণের কোনো সম্ভবনা নেই। এমনকি আমাদের কাছে নতুন করে এমন কোনো তথ্য নেই। হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোথাও পঙ্গপাল আক্রমণ করেনি এবং আবহাওয়ার কারণে তার শঙ্কাও নেই। বিভিন্ন জন বিভিন্ন পারপাস থেকে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে। আমাদের তথ্যে পঙ্গপাল নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছি না।’ এর আগ মার্চে সারাবাংলাকে তিনিও বলেছিলেন, ‘পঙ্গপাল নিয়ে আমরা আমাদের হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তারা বলছে, বাংলাদেশে পঙ্গপাল নেই এবং আক্রমণের সম্ভাবনা নেই।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার পরিচালক ছাব্বির বিন জাহান সোমবার (২৭ এপ্রিল) সারাবাংলাকে বলেন, ‘পঙ্গপাল নিয়ে আমাদের এখানে কোনো সংবাদ নেই আপতত। আগে যেমন বলেছিলাম, এখনও সেই রকমই অবস্থা।’ আর আগে মার্চের প্রথম সপ্তাহে সারাবাংলাকে তিনি বলেছিলেন, ‘পঙ্গপাল নিয়ে আমাদের এখনো কোন ঝুঁকি নেই। দেশের কোথাও এর উপস্থিতি দেখা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। আক্রমণ দেখা গেলে সরকার ব্যবস্থা নেবে। এখন পর্যন্ত এটি নিয়ে কোন শঙ্কা নেই।’
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উংয়ের সাবেক পরিচালক কৃষিবিদ চন্ডী দাস কুন্ডু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি ডেজার্ট পঙ্গপাল। মরুভূমিতেই হয়, মরুভূমির ফল-মূল খায়। তথ্যগতভাবে এটি বাংলাদেশে আসার কোনো শঙ্কা নেই। তবে হানা দেবে না এমন তথ্যও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা প্রত্যাশা করি এটা হানা না দিক।’
পঙ্গপাল: পঙ্গপাল ঘাস ফড়িংয়ের একটি জাত। ঘাস ফড়িং একা থাকতে পছন্দ করলেও পঙ্গপাল দলবেঁধে উড়ে চলে। সাধারণত একেক ঝাঁকে কয়েক লাখ থেকে এক হাজার কোটি পতঙ্গ থাকতে পারে। একটি পূর্ণ বয়স্ক পঙ্গপাল প্রতিদিন তার ওজনের সমপরিমাণ খাদ্য খেতে পারে। যে অঞ্চলে তারা আক্রমণ করে, সেখানে খাদ্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা অন্য অঞ্চলে যায় না।
সম্প্রতি অফ্রিকার কয়েকটি দেশের পর পাকিস্তান ও ভারতেও পঙ্গপালের আক্রমণ দেখা দেয়। আর চলতি বছরের প্রথম দিকে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পঙ্গপাল নিয়ে একটি সতর্কতামূলক মানচিত্র প্রকাশ করে। সেখানে সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া ছাড়াও সুদান, কেনিয়া, সৌদি আরব, ইরান ও ওমানকে পঙ্গপাল আক্রান্ত দেশ হিসাবে দেখানো হয়। পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশের পাকিস্তান ও ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে এর তীব্র আক্রমণের চিত্র দেখানো হয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও পঙ্গপালের আক্রমণ হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলছে। আর এফএও ও দেশের কৃষিসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশ পঙ্গপাল আক্রমণের ঝুঁকি নেই।