Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মৃত্যুর একদিন আগেও পদ্মাসেতুর খোঁজ নিয়েছিলেন অধ্যাপক জামিলুর


২৮ এপ্রিল ২০২০ ২০:৪১

ঢাকা: পদ্মাসেতু নির্মাণ শুরুর পর সবচেয়ে বড় যে বাধার মুখে পড়েছিল, সেটি হলো পিলার বা খুঁটি স্থাপন বিষয়ক জটিলতা। পদ্মার তলদেশের মাটির প্রকৃতি আশানুরূপ না হওয়ায় সাধারণ পদ্ধতিতে স্প্যান বসানো যায়নি। এ সমস্যার সমাধানে সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান হিসেবে মূল ভূমিকায় ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। সম্ভাব্য বেশকিছু সমাধানের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছিল তাকেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সোনা ফলিয়ে আসা এই প্রকৌশলী তার জীবনের শেষ প্রকল্প পদ্মাসেতুর জন্যও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। মৃত্যুর আগের দিনও সেতু প্রকল্পের একজন প্রকৌশলীকে ফোন করেছিলেন সেতুর খোঁজখবর নিতে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) ভোরের দিকে ঘুমের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। মঙ্গলবার বাদ জোহর জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন খ্যাতনামা এই প্রকৌশলী। দেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে পাঁচ সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। সবশেষ পদ্মাসেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলেরও প্রধান ছিলেন। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান বড় বড় প্রকল্পগুলোতেও তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্বে। দেশের অবকাঠামো নির্মাণ খাতে যখনই কোনো সমস্যা দেখা গেছে, শরণাপন্ন হতে হয়েছে এই স্বনামধন্য প্রকৌশলীর।

জানুয়ারি মাসে সপরিবারে পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসেছিলেন। সে সময় এ প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, মেয়ে-জামাই ও নাতিকে পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকা দেখাতে নিয়ে এসেছেন। ওই সময় সারাবাংলাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কিভাবে পদ্মাসেতুর খুঁটি স্থাপনে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান এসেছিল।

পদ্মাসেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের সারাবাংলাকে বলেন, গত পরশু আমার মোবাইলে ফোন করেছিলেন জামিলুর রেজা স্যার। ফোন ধরতে পারিনি, সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করেছিলাম। জানতে চাইলেন, প্রকল্পের চীনে থাকা যন্ত্রাংশগুলো কবে নাগাদ আসবে দেশে।

কেবল দেওয়ান আব্দুল কাদের নয়, সেতুর অন্য প্রকৌশলীরাও জানান, পদ্মাসেতু প্রকল্প নিয়ে সবসময় ভাবতেন জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি নিজে থেকেই বিভিন্ন সময় সেতু সংশ্লিষ্টদের ফোন করে খবরাখবর নিতেন।

বিজ্ঞাপন

এর আগে, পদ্মা নদীর তলদেশের মাটির প্রকৃতির কারণে সেতুর ১১টি খুঁটি বসানো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। ওই সময় আরও একটি শক্তিশালী হ্যামার আনার কথা বলা হয়েছিল। সেটি আনতে গেলে সেতুর কাজ এক থেকে দেড় বছর পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সে কারণে বিরল হলেও ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ পদ্ধতিকেই বেছে নেন জামিলুর রেজা। তাতে ফলও পাওয়া যায়।

সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, পদ্মাসেতু প্রকল্পে জামিলুর রেজার অসামান্য ভূমিকা ছিল। তাকে এমন ক্ষমতা দেওয়া ছিল যে তিনি সেতুর কাঠামোগত যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। নিজের মেধা আর প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি সেই ক্ষমতাকেও ব্যবহার করেছেন জটিল থেকে জটিলতর সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য। তার তীক্ষ্ণ বিবেচনাতেই এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতায় আটকে যায়নি পদ্মাসেতুর কাজ।

একনজরে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী

বহুগুণে গুণান্বিত জামিলুর রেজা চৌধুরী একাধারে ছিলেন খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪২ সালে, সিলেটে। তার বাবাও ছিলেন প্রকৌশলী, তার মেয়েও একজন প্রকৌশলী। অর্থাৎ তিন প্রজন্মের প্রকৌশলী রয়েছে অধ্যাপক জামিলুর রেজার পরিবারে।

ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন জামিলুর রেজা। ১৯৬৩ সালে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশলে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটান থেকে এমএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

২০০১ সাল পর্যন্ত জামিলুর রেজা বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তিনি। সবশেষ এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জামিলুর রেজা। ২০১৭ সালে তিনি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন।

পেশাগত দায়িত্বের বাইরে তিনি আর্থকোয়েক সোসাইটি, পরিবেশ আন্দোলন বাপা ও গণিত অলিম্পিয়াডের মতো বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব যেমন— বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সফটওয়্যার রফতানি ও আইটি সার্ভিস রফতানি সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী জামিলুর রেজা চৌধুরী পদ্মাসেতু পদ্মাসেতু প্রকল্প প্রকৌশলী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর