কোভিড-১৯: প্রতিকার নয় প্রতিরোধ ফর্মুলায় জিতেছে ভিয়েতনাম
৯ মে ২০২০ ০১:৪৫
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মাহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সারাবিশ্ব যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন করোনা মোকাবিলায় অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র আর আয়তনে ছোট একটি দেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছে সবাইকে। বিশ্বের ‘মোড়ল’ দেশগুলো যখন করোনা ঠেকাতে না পেরে মোকাবিলায় গলদঘর্ম, তখন সেই দেশটির সাফল্য রীতিমতো ঈর্ষণীয়। সেই দেশটির নাম ভিয়েতনাম।
ওয়ার্ল্ডমিটারের তথ্য বলছে, শুক্রবার (৮ মে) পর্যন্ত ১০ কোটি মানুষের দেশ ভিয়েতনামে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২৮৮। এর মধ্যে ২৪১ জন আবার সুস্থ হয়ে নিয়মিত জীবনে ফিরেও গেছেন। আর কোনো প্রাণহানির ঘটনাও নেই। নভেল করনোভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীন থেকে মাত্র ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরের প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ভাইরাস মোকাবিলায় ভিয়েতনামের এই অভাবনীয় সাফল্যের রহস্য কী? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে পাওয়া তথ্য থেকে সেই রহস্যেরই সন্ধান করা যাক।
তথ্য গোপন না করা
২৩ জানুয়ারি
নভেল করোনাভাইরাসের উতপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে ভিয়েতনামে ফেরা ৬৬ বছর বয়সী এক ভিয়েতনামি দেশটিতে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন। ভিয়েতনাম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ জানুয়ারি প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের খবর প্রকাশ করে।
আগাম লকডাউন, প্রচুর টেস্ট
১১ ফেব্রুয়ারি
এদিন ভিয়েতনামে কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ জনে। তাদের মধ্যে দু’জন চীনা নাগরিক, বাকি ১২ জন ভিয়েতনামের নাগরিক। গণসংক্রমণ ঠেকাতে তখনই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পাশাপাশি নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে। করোনাভাইরাস মোকাবিলাকে যুদ্ধের সমপর্যায়ে বিবেচনা করে, ভিয়েতনাম স্বাস্থ্য দফতর শুধুমাত্র লিফলেট বিতরণ, মাইকিং বা টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার নয়, সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটি বুঝিয়েছে। যার কারণে উপসর্গ দেখা দিলেই তারা স্বাস্থ্য বিভাগের শরণাপন্ন হয়েছে।
এর বাইরেও ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যবিভাগ সন্দেহভাজনদের খুঁজে খুঁজে টেস্ট করানোর উদ্যোগ নেয়।
ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাদের আর্মি মেডিকেল কোরের বানানো একটি টেস্টিং কিট দিয়ে নাগরিকদের করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ক্রমেই সেই টেস্টিং কিটের সাফল্যে আরও ২০ দেশ তাদের কাছ থেকে এই কিট সংগ্রহ করে। ভিয়েতনামের এই কিটের একটি বিশেষত্ব রয়েছে— একটি টেস্টিং কিট দিয়ে ৫০টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়।
জিরো টলারেন্স, বাধ্যতামূলক কোয়ারেনটাইন
২ মার্চ
করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভিয়েতনামের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে বাগড়া দেন একজন প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ী। ইউরোপের তিনটি দেশ ঘুরে তিনি হ্যানয় বিমানবন্দরের দায়িত্বরত কর্মচারীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, টেস্ট না করিয়েই দেশে ঢুকে পড়েন। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের ফাঁকি দিতে পারলেও ভিয়েতনামের পুলিশ তাকে ঠিকই আটক করে। এরপর টেস্ট করে জানা যায়, তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত।
তারপর, ভিয়েতনাম সরকার এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। ওই নারী যে ফ্লাইটে এসেছিলেন, ওই ফ্লাইটের সব যাত্রীকে কোয়ারেনটাইনে রাখা হয়। তিনি যে রাস্তা ব্যবহার করেছিলেন, রাস্তা জীবাণুমুক্তকরণসহ রাস্তার আশেপাশে বসবাসকারী প্রত্যেককে করোনাভাইরাস টেস্ট করানো হয়। কিন্তু, এ মহাযজ্ঞের পরও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪৯-এ।
কোয়ারেনটাইনের ব্যাপারে কয়েকজন বিদেশি নাগরিক তাদের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেছেন, এমন সুব্যবস্থাপনা তার নিজের বাড়িতেও বিরল। তাই কোয়ারেনটাইনে থাকা মানে যে দুনিয়া বিচ্ছিন্ন একটা জায়গায় কয়েদির মতো আটকে থাকা, সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে এ লড়াইয়ে জয়ের পথে অনেকখানি এগিয়ে গেছে ভিয়েতনাম।
স্বাস্থ্য বিভাগের ক্ষমতায়ন
এটি ভিয়েতনামে নতুন কিছু নয়, বরং পুরনো চর্চাটিই কোভিড প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে কাজ দিয়েছে। দেশটিতে সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে গুরুত্বপূর্ণ হিসবে বিবেচনা করা হয়। সে কারণে তারা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শতভাগ সন্দেহভাজনদের টেস্ট করানো, আক্রান্তদের চিকিৎসার আওতায় আনতে পেরেছে তারা। এক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিভাগের যে যোগাযোগ, তা প্রশংসার দাবি রাখে। তা কিন্তু একদিনে সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ভিয়েতনাম এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তার ফলও তারা লাভ করল এই করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে গিয়ে।
ভিয়েতনাম তাদের নিজের দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। তারা ইউরোপ, আমেরিকা ও নিজেদের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ভাইরাস প্রতিরোধক স্যুট, মাস্ক ও করোনাভাইরাসের টেস্টিং কিট সরবরাহ করে, তাদের লড়াইয়েও ভূমিকা রেখেছে।
সব মিলিয়ে করোনাকালে গোটা বিশ্বের মধ্যে ভিয়েতনামকে বলা যায় রোল মডেল। করোনার এই দুর্যোগে যে গুটিকয়েক দেশ নাগরিকদের স্বস্তিতে রাখতে পেরেছে, তার মধ্যে ভিয়েতনাম একটি। একদম শুরুতেই করোনাকে প্রতিরোধের যে কৌশল সরকার নিয়েছে, জনগণের সমর্থন সেই কৌশলকেই সফল করে তুলেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিকে।
কোভিড-১৯ কোয়ারেনটাইন টেস্টিং কিট নভেল করোনাভাইরাস ভিয়েতনাম লকডাউন স্বাস্থ্য বিভাগ