সরকারি নিরাপত্তা নীতিমালা ছাড়াই চলছে পোশাক কারখানা
৩০ এপ্রিল ২০২০ ০৯:৫৫
ঢাকা: করোনাভাইরাসের কারণে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতেও চলছে দেশের অনেক তৈরি পোশাক কারখানা, এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো দেওয়া হয়নি কোনো নিরাপত্তা নীতিমালা বা গাইডলাইন। বেশিরভাগ কারখানা পুরোদমে কাজ চালালেও সরকার এখন গাইডলাইন তৈরি করছে বলে জানিয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফত কর্তৃপক্ষ।
এই গাইডলাইন তৈরিতে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে সরকারি সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর।
তবে ওই গাইডলাইনটিতেও তেমন কোনো নতুনত্ব না থাকার আভাস পাওয়া গেছে। প্রচলিত স্বাস্থ্যবিধি ও পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-্এর গাইডলাইনকেই সরকারের গাইডলাইনে প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের সেইফটি শাখার যুগ্ম মহাপরিদর্শক প্রকৌশলী ফরিদ আহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইএলও থেকে আমাদের একটি গাইডলাইন তৈরি করতে বলেছে। আমরা তার ড্রাফট তৈরি করছি। এখনো গাইডলাইনটি চূড়ান্ত হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে আগে আমরা যেসব লিফলেট বিতরণ করেছি, হাত ধোঁয়ার কথা বলেছি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলেছি; গাইডলাইনের খসড়ায় সেগুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। নতুন করে তেমন কিছু যুক্ত করা হয়নি।’ কোনো কারখানায় যদি স্বাস্থ্যবিধি মানা না হয় কিংবা গাইডলাইনের শর্ত না মানা হয় সেক্ষেত্রে শাস্তির বিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আইন তো হঠাৎ করে তৈরি করা যায় না। স্বাস্থ্য বিধি না মানলে প্রচলিত নিয়মে যে শাস্তি হওয়ার কথা, তাই হবে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর বর্তমান কমিটির একজন শীর্ষ নেতা সারাবাংলাকে বলেছেন, ‘কারখানা চালুর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি নির্দেশনা রয়েছে। আমরা তা মেনে চলার চেষ্টা করছি। কলকারখানা অধিদফতর থেকে কোন গাইডলাইন তৈরি করা হয়নি। তারা একটি ড্রাফট তৈরি করেছে বলে আমরা জেনেছি। আর বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বিশদ গাইডলাইন প্রকাশ করা হয়েছে। কারখানাগুলো তা সাধ্যাতীত মেনে চলার চেষ্টা করছে।’
জানা গেছে, শিল্প কারখানায় কর্মরতদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে শিল্প কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার পূর্বে ও কাজ করার সময়কালের করণীয় বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। শ্রমিকের জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট আছে কি না তা দেখার কথা বলা হয়েছে। শারীরিক দূরত্ব, কারখানায় শ্রমিক প্রবেশের সময় তার জুতা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা, মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজার ব্যবহার, গাড়ি জীবাণুমুক্ত করা, কারখানায় বসার ক্ষেত্রে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে ওই নির্দেশনায়। কারখানায় কোনো কর্মী করোনায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা কারখানা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানানো হয়েছে ওই নির্দেশনায়। তবে নির্দেশনা মানা না হলে শাস্তির বিধানের বিষয়টি এই নির্দেশনায় উল্লেখ নেই।
এছাড়া করোনায় কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে বিজিএমইএ’র একটি গাইডলাইন রয়েছে। ২২ এপ্রিল সেই গাইডলাইনটি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে নিকটবর্তী কর্মীদের নিয়ে কারখানা চালু করার কথা বলা হয়েছে। গ্রাম থেকে যারা ফিরে এসেছে তাদের কাজে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফিনিশিং সেকশন, স্যাম্পল সেকশন ও স্যুয়িং সেকশন আংশিকভাবে খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলেও ওই গাইডলাইনে বলা হয়েছে।
এছাড়া কারখানা প্রাঙ্গণে ঘনত্ব হ্রাসের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে একাধিক শিফট বা নির্ধারিত সময়ের আগে কারখানা খোলা ও দেরিতে বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রবেশের পথে স্বাস্থ্যবিধিগুলো জোরদারের কথা বলা হয়েছে। ঘনত্বপূর্ণ স্থানে কারখানার ভেতরের চলাচল একমুখী করার নির্দেশনাও রয়েছে। গাইডলাইনটিতে কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকের চিকিৎসা, আক্রান্ত হলে ছুটিসহ স্বাস্থ্যবিধির প্রায় সব বিষয় উল্লেখ রয়েছে। তবে এসব বিষয় মানা না হলে কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে গাইডলাইনে তা উল্লেখ নেই।
এদিকে, ২৬ এপ্রিল থেকে বিজেএমইএ তাদের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করেছে। দেশের বিভিন্ন জোনে মনিটর নিয়োগ করা হয়েছে। কারখানায় কেউ আক্রান্ত হলে সুনির্দিষ্ট মনিটরগণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া বিজিএমইএ’ একটি কন্ট্রোলরুমও খুলেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্ব্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। সারা দুনিয়া যেভাবে চলছে আমরাও সেভাবে চলার চেষ্টা করছি। তবে উন্নত দেশে যেভাবে নিয়ম মানা হচ্ছে, আমরা হয়তো তা পারছি না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা তো সরকারি গাইডলাইনই। মহামারির সময় তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইনেই চলার কথা। তাছাড়া ফ্যাক্টরিগুলো কমপ্লাইনন্স মেনে চলছে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছে।’
আর বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের শিল্প দেশের আইনেই চলছে। স্বাস্থ্যগত বিষয়তো আমরা মেনেই চলছি। বরং শ্রমিকরা যখন বাসায় যাচ্ছে- একে অপরের সঙ্গে গড়াগড়ি করে যাচ্ছে। বাসায় পাঁচ-ছয় জন একসঙ্গে ঘুমাচ্ছে। আমরা তো সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। কারখানার ভেতরের চেয়ে আমরা তাদের বাইরের পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত। যেহেতু আমরা আন্তর্জাতিক ব্যবসা করি ফ্যাক্টরিগুলো কমপ্লাইন্স মেনে চলছে।’
পোশাক মালিক অনন্ত জলিল বলেন, ‘অমরা যারা কমপ্লায়েন্স ফাক্টরি তাদের প্রতিটি যায়গা ফুলের মতো সাজিয়ে রাখতে হয়। লাইক এ মিউজিয়াম। আমরা অনেক যুদ্ধ করে ফ্যাক্টরি চালাচ্ছি। আমাদের ফ্যাক্টরিতে হেলথ অ্যান্ড সেফটি ইস্যুগুলো পরিপূর্ণভাবে মানা হচ্ছে। সেগুলো আবার ভিডিও আকারে আমার ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিন প্রকাশ করা হচ্ছে। ৩০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে কারখানা চালু করার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
এদিকে, সুরক্ষা নিশ্চিত না করে শ্রমিকদের কাজে আনলে ঝামেলা বাড়বে বলে সতর্ক করেছে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এ ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সংস্থাটির নেওয়া ত্রিমুখি কৌশল বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। আইএলও’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের সঙ্গে যৌথভাবে আইএলও করোনা প্রতিরোধে যে গাইডলাইন প্রস্তুত করছে, তা মেনে চলতে হবে। যাতে কর্মীদের মধ্যে করোনা সংক্রমিত না হয়। এই দুর্যোগে সকল শ্রেণির কর্মীদের ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্য ভাতাসহ সকল সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’