রাজধানীতে অনেকেই জানে না কোথায় করোনার চিকিৎসা-নমুনা পরীক্ষা হয়
২ মে ২০২০ ১৯:০৮
ঢাকা: ইতোমধ্যেই দেশে ৭ হাজার ৬৬৭ জনের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এছাড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ১৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানানো হলেও খোদ রাজধানীর বিশাল একটা জনগোষ্ঠী জানেই না কোথায়, কিভাবে কোভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা করা যাবে বা কোথায় চিকিৎসা পাওয়া যাবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কোভিড-১৯ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে এসব হাসপাতালগুলোতে গিয়ে বেড খালি না থাকায় ভর্তি হতে না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
নতুন আক্রান্ত ৫৫২, মৃত্যু আরও ৫ জনের
রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- গত ১ মে, শ্রমিক দিবসে রাজধানীর উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর রোডে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন মো. বারেক। পরনে একটি রেইনকোট সদৃশ পোশাক থাকলেও মুখে নেই কোনো মাস্ক, হাতে নেই কোনো গ্লোভস।
কথা বলতেই জানা গেলো ডিএনসিসি থেকে তাদের মাস্কসহ নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রী হিসেবে চশমা ও গ্লোভস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো পরে কাজ করতে সমস্যা হয় তাই তিনি পরেন না। এতে করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তিনি জানান কোথায় চিকিৎসা করাতে হবে তা তার জানা নেই। ডিএনসিসির পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি বলেও জানান তিনি। কোথায় নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে সে বিষয়েও তার জানা নেই।
এক প্রশ্নের তিনি বলেন, অফিস থেকে ফোন দিয়ে বলা হয়, যদি নমুনা পরীক্ষা করতে হয় তবে যাতে ১৬২৬৩, ৩৩৩ এই নম্বরগুলোতে ফোন করি। যদি আমার পরীক্ষা করতে হয় তবে আমি সেই নম্বরেই ফোন দেবো। সেখান থেকে আমাদের যেখানে যেতে বলবে পরীক্ষা করানোর জন্য সেখানে যাবো। এই নম্বরগুলোতে আমি ফোন দেইনি কিন্তু শুনেছি এখানে ফোন দিলে জানা যায় কিভাবে কী করতে হবে।
তিনি বলেন, সাধারন ভাবে যদি আমি ডাক্তারের কাছে যাই তবে চিকিৎসা হবে না। তাই আমাদের জন্য যদি কোথায় চিকিৎসা নেওয়া যাবে তা জানিয়ে দেওয়া হয় তবে আমরা সেখানে যেতে পারবো। একটা নাম দিয়ে যে হাসপাতালে যেতে বলতে সেখানেই যাব আমরা।
এখনো কোথায় নমুনা পরীক্ষা করতে হয় তা জানি না মন্তব্য করে তিনি বলেন, যদি আমাদের কোনো ঠিকানা দেয় কোথায় গেলে নমুনা পরীক্ষা করানো যাবে তবে আমরা সেখানেই যাবো।
এছাড়া রাজধানীতেই রিকশা চালান আবদুল কাদের জিলানী। প্রতিদিন আশুলিয়া থেকে আসেন রাজধানীতে। সংসারের খরচ চালানোর জন্য প্রতিদিনই রিকশা চালাতে হয়। এক দুইদিন সাহায্য পেলেও প্রতিদিন তো পাওয়া সম্ভব না আর তাই রিকশা চালান বলে জানান তিনি।
একটি সাধারণ মাস্ক পরে রিকশা চালালেও তিনি জানেন না কোথায় গিয়ে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে। পরিবারের সঙ্গে থাকা আবদুল কাদের জানালেন যদি অসুস্থ হন তবে তিনি উত্তরায় অবস্থিত বাংলাদেশ মেডিকেল বলে পরিচিত উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে যাওয়ার কথা জানান। কিন্তু সেখানে কোভিড-১৯ চিকিৎসা দেওয়া হয় না শোনার পরে তিনি আসলে কোথায় যেতে হবে তা জানেন না বলেই জানান। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে যেসব নম্বর দেওয়া হচ্ছে তাও তার জানা নেই বলে জানান।
এক্ষেত্রে তিনি বলেন, যদি সরকারের পক্ষ থেকে সবার মোবাইলে কোন নম্বরে ফোন দিলে নমুনা পরীক্ষা করানো যাবে ও কোন নম্বরে ফোন দিলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে তা একটি মেসেজ আকারে দেওয়া যায় তবে সবাই জানতে পারবে।
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা সোহেল ইসলাম (ছদ্মনাম)। কাজ করেন বাংলাদেশ বিমানের একটি শাখায়। প্রায় আট দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। নিজেকে হোম কোয়ারেনটাইনেই রেখেছিলেন এই সময়টা। ২৮ এপ্রিল সকাল থেকে কোভিড-১৯ টেস্ট করানো জন্য অপেক্ষা করছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) সামনে। পরিচিত একজন ব্যক্তির কাছ থেকে শুনে এলেও এখানে এসে তিনি জানতে পারেন নমুনা সংগ্রহ এখানে করা হয় না। শুধুমাত্র পরীক্ষা করানো হয়। এ সময় উনার কথা হয় সারাবাংলা.নেটের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমি এখন টেস্ট কোথায় করাবো যেখান থেকে নমুনা পরীক্ষা করানো যাবে অন্তত? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) তো সকালে গিয়েও অনেকে নমুনা জমা দিতে পারে না কারণ সেখানেও একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কোথায় গিয়ে নমুনা জমা দিতে পারবো সেটা জানলেও তো অন্তত সেখানে যাওয়া যায়।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রাজীব চৌধুরী (ছদ্মনাম)। কাজ করেন একটি সুপার শপে। আর তাই লকডাউনের মধ্যেও তাকে কাজে যেতে হয়েছে প্রতিদিনই আগে থেকেই তার উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়বেটিস আছে। কিছুদিন ধরেই ভুগছেন জ্বরে। একই সঙ্গে আছে কাশি ও গলা ব্যাথা। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য যান পাশেই থাকা একটি হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন আইইডিসিআরে যোগাযোগ করার হটলাইন নম্বর ১০৬৫৫। এখানে ফোন করার পরেও কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। এ সময় উনার কথা হয় সারাবাংলা.নেটের প্রতিবেদকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ল্যাবের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেসব স্থানে তো আর নমুনা জমা নেওয়া হচ্ছে না। অন্তত নমুনা কোথায় গিয়ে নমুনা দিতে পারবো সেটাও যদি বলা হয় তাও কিছুটা উপকার হতো। বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গিয়ে নমুনা যদি জমা দিতে হয় তবে সেটা কী নিরাপদ? বসুন্ধরা থেকে আমি যে সেইদিকে যাবো, যদি আমার মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে থাকে তবে তা অন্য কারও মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। তাই না? কারণ আমি তো নিশ্চয় হেঁটে যাবো না।
২৭ এপ্রিল আইইডিসিআর-এর সামনে গিয়ে দেখা যায় সেখানে অপেক্ষা করছেন রামপুরা থেকে আসা রুকসানা পারভীন (ছদ্মনাম)। কিন্তু এখানে তাকে জানানো হয় নমুনা পরীক্ষা এখানে করা হলেও নমুনা সংগ্রহ এখানে করা হয় না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়েই এই বিষয়ে মার্চ মাসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে তাকে।
তিনি বলেন, উনারা এর আগে জানিয়েছিলেন এখানে নমুনা সংগ্রহ করা হয় না। আমি সেটা জেনেও এখানে এসেছি। কারণ আমি জানতে চাই অন্তত কোথায় গেলে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারবো। সেগুলোর যোগাযোগের উপায় বা কোথায় গেলে পরীক্ষা করানো যাবে তা কী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো উচিত না?
রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে পাওয়া এমন প্রশ্ন এখন প্রায় সবারই মুখে মুখে। বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী নেওয়া হচ্ছে না নমুনা পরীক্ষার ফলাফল না থাকার কারণে-এমন অভিযোগও গণমাধ্যমে আসছে প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু সেই নমুনা পরীক্ষা কোথায় গেলে করানো হবে, কিভাবে করানো হবে তা নিয়ে এখনো স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই ল্যাবের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হলেও সেই ল্যাবে কিভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হবে তা বলা হয় না। বিএসএমএমইউ, ঢামেকে গিয়ে নমুনা জমা দিতে পারলেও সেখানে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষেই তা সীমাবদ্ধ থাকছে। আইইডিসিআর’র হটলাইন নম্বরে ফোন করে নমুনা সংগ্রহ করার কথা বলা হলেও তাতে থাকছে দীর্ঘসূত্রিতা। এক্ষেত্রেও তাদের যে হটলাইন নম্বর দেওয়া হয় তাতে প্রায় সময় যোগাযোগ করতে না পারার অভিযোগও আছে। তবে এক্ষেত্রে প্রতিষ্টানটির পক্ষ থেকে দেওয়া হান্টিং নম্বর ০১৯৪৪৩৩৩২২২-এ যোগাযোগ করে এক দুই মিনিট অপেক্ষা করতে হলেও সেখানে নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে যোগাযোগ করা যায়। কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই।
সংশ্লিষ্ট ল্যাবগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের নমুনা সংগ্রহ করার সীমাবদ্ধতার কথা। মূলত বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা নমুনা তারা পরীক্ষা করতে পারলেও সেই সব ল্যাবে গিয়ে নমুনা জমা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই হাসপাতালগুলো বাদে।
যদি সাধারণ মানুষের কাছেই নমুনা পরীক্ষা করানোর উপায় পরিষ্কার ভাবে বার্তা পৌছানো না যায় তবে কতটা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ?
এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা বাড়াতেই হবে। এর বিকল্প নেই। কিন্তু এই পরীক্ষা বাড়ানোর জন্য শুধু ল্যাব বাড়ালেই হবে না। এর সঙ্গে বাড়াতে হবে নমুনা সংগ্রহ করার ব্যবস্থাও। আর এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এগিয়ে আসতে হবে। ল্যাবের সংখ্যা প্রচার করার চাইতে মানুষের কাছে সঠিকভাবে কোথায় যোগাযোগ করলে কিভাবে নমুনা পরীক্ষা করানো যাবে তার বার্তা দিতে হবে। প্রতিটা এলাকায় যদি বুথ স্থাপন করা সম্ভব হয় ও সেই সব বুথের বিষয়ে সঠিকভাবে জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছানো যায় তবে এই সমস্যা কিছুটা সমাধান হবে। এই ক্ষেত্রে সকল এলাকায় কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য বিধি মেনে কিভাবে নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করা যায় তা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানোর কথা প্রতিদিন বলা হলেও নমুনা সংগ্রহ কোথায় হবে বা কিভাবে হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, বিএসএমএমইউ ও ঢামেকে গেলেই নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। বেসরকারিভাবে ঢাকার বিভিন্ন স্থানেও বসানো হচ্ছে নমুনা সংগ্রহ বুথ। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদ্যোগে থেকে ব্র্যাকের পক্ষ থেকেও বেশ কিছু স্থানে বসানো হচ্ছে নমুনা সংগ্রহের বুথ। সেসব স্থানেই নমুনা সংগ্রহ করা হবে যেগুলো বিভিন্ন ল্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু এই নমুনা সংগ্রহের স্থানগুলো কোথায় বা যোগাযোগের উপায় এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, এ বিষয়ে আমরা চেষ্টা করব সকল ল্যাব ও বুথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায় তা স্বাস্থ্য বুলেটিনে প্রচার করতে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গঠিত মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেলের আহবায়ক হাবিবুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।