স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধা হামলা-মামলা, ছাঁটাই
৩ মে ২০২০ ০৯:০১
ঢাকা: করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে যখন সারাবিশ্বে মহামারি দেখা দিয়েছে; যখন ভাইরাসটির বিস্তার রোধে মানুষ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে গিয়ে নিজেদের প্রায় গৃহবন্দি করে ফেলেছে; যখন করোনা মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের কাতারে শামিল সারাবিশ্বের গণমাধ্যমকর্মীরা তখন আগের বছরগুলোর মতোই আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস।
প্রতিবছরের ৩ মে পৃথিবীর সবগুলো দেশে এই দিবসটি পালিত হয়। এবার করোনা পরিস্থিতি দিবসটি পালনে কিছুটা ব্যাত্যয় ঘটিয়েছে। তারপরও প্রতিবছরের মতো বিশ্বের প্রতিটি দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির লক্ষ্য স্বাধীন সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা হলেও বাংলাদেশে গণমাধ্যমকর্মীরা কতটা স্বাধীন সেটা নিয়ে রয়েছে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা।
বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, উগ্র মৌলবাদ, হয়রানিমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এছাড়াও কর্তৃপক্ষের অপেশাদার আচরণ, নিয়মিত বেতন না হওয়া, ছাঁটাইয়ের ভয় এবং হুটহাট গণমাধ্যম অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
গেল ২৩ এপ্রিলও একটি জাতীয় দৈনিক থেকে অন্তত ২০ জন সংবাদকর্মীকে একসঙ্গে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অপর একটি দৈনিকের ছাপা সংস্করণ। এর ধারাকাহিকতায় গত এক সপ্তাহে অন্তত চারটি দৈনিকের ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে একজনও ফটো সাংবাদিকও নিখোঁজ হয়েছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে খবর ছাপানোয় তাকে ‘অপহরণ’ করা হয়েছে। এছাড়া গত বছরের শেষ দিকে একটি টেলিভিশন চ্যানেল বার্তা বিভাগকে ‘লস প্রজেক্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে।
এসব কারণে ২০২০ সালে প্রকাশ হওয়া মুক্ত গণমাধ্যম সূচকেও বাংলাদেশ গতবছরের তুলনায় আরও এক ধাপ পিছিয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এর সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম।
বাংলাদেশ যে পিছিয়েছে শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যেও দেশটির অবস্থান সবার নিচে। তালিকায় ৬৭ নম্বরে থাকা ভুটান এ অঞ্চলে মুক্ত সাংবাদিকতার শীর্ষে। এরপরই ৭৯তম অবস্থানে আছে মালদ্বীপ। ভারত ১৪২, পাকিস্তান ১৪৫, শ্রীলঙ্কা ১২৭, নেপাল ১১২ ও আফগানিস্তান ১২২। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে আসা মিয়ানমারও এই তালিকায় বাংলাদেশের আগে অবস্থান করছে। তাদের অবস্থান ১৩৯তম।
মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে কেন এতটা পিছিয়ে বাংলাদেশ? উত্তরে আরএসএফ বলছে, দেশটিতে সংবাদপত্রে স্বাধীনতার লঙ্ঘন বেড়েছে। সরকারের কঠোর নীতির কারণেই স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকরা হামলার শিকার হচ্ছেন। এমনকি তাদের ওয়েবসাইট পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেল-জরিমানা এবং সার্কুলেশন বা ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যাওয়া এড়াতে অনেক প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই সংবাদ প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছেন।
আরএসএফ’র মতে, সেল্ফ সেন্সরসিপ এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেকারণে ২০১৩ সালে থেকে ২০১৮ সাল মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৪৪ থেকে ১৪৬ এর মধ্যে থাকলেও এখন এটি ১৫১তে নেমেছে।
এদিকে করোনাকালে যেসব খাত সংকটে পড়েছে গণমাধ্যম তার অন্যতম। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে এরই মধ্যেই একজন সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পরিবারের সদস্যরাসহ আক্রান্ত হয়েছেন আরও অনেক সাংবাদিক। কিন্তু সরকার ঘোষিত প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে সাংবাদিকদের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। যেখানে চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে ব্যাংকারদের পর্যন্ত প্রণোদনার আওতায় রাখা হয়েছে।
তবে প্রণোদনা বরাদ্দে বাংলাদেশের ঠিক উল্টো চরিত্র দেখা গেছে ভারতে। দেশটির হরিয়ানা রাজ্য সরকার করোনাভাইরাস সংক্রান্ত রিপোর্টিংয়ে যুক্ত সাংবাদিকদের জন্য ১০ লাখ রুপির বিমাও ঘোষণা করেছে। এমনকি পাকিস্তানেও করোনার সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারে সাংবাদিকের মৃত্যু হলে ১০ লাখ টাকা ও তার স্ত্রীকে মাসিক ১০ হাজার টাকা করে আজীবন পেনশনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে হামলা, মামলাসহ, দুর্যোগে ঝুঁকিভাতা বা প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকার কারণেই গণমাধ্যমকর্মীরা মুক্তভাবে সাংবাদিকতা করতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রতিবেদক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যম নিয়ে অসহিষ্ণুতার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, ব্যবসায়ী, নেতা-এমপিরা মানহানি কিংবা আইসিটি মামলা দিয়ে আমাদের আটকে রাখতে চায়। অনেক সময় ফেসবুকে লেখার কারণেও সাংবাদিকদের আক্রান্ত হতে হয় ‘এসব কারণেই মুক্তভাবে সাংবাদিকতা করা এখন সম্ভব হয়ে উঠছে না বলেও দাবি করেন রাজনৈতিক বিটের এই প্রতিবেদক।
তবে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বলছেন ভিন্ন কথা। সাংবাদিকতার গুণগত মান বিকাশ না হওয়াকেই বর্তমান পরিস্থিতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন তিনি।
জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে যেভাবে গণমাধ্যমের বিকাশ হয়েছে, সেভাবে সাংবাদিকতার গুণগত মান বাড়েনি। ফলে অনেকেই নর্মস মেনে সাংবাদিকতা করেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করা হয়, কিন্তু অভিযুক্তের বক্তব্য নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ মুক্ত গণমাধ্যম আছে বলেই অনিয়মের বিরুদ্ধে এত খবর প্রকাশ করা যায়। এসব খবরও এখন যথাযথভাবে তৈরি করা হয় না। খবর লিখতে গিয়ে সাংবাদিকরা একটিভিস্ট হয়ে যান।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ অথবা ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতিবছর সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এর আগে ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশন এই দিবস ঘোষণার সুপারিশ করা হয়।
সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ ও পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত এবং জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হয় এই দিবসটিতে।
‘জার্নালিজম উইথ আউট ফিয়ার অর ফেভার’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবার এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও তাদের পেশাগত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এই দিবসটি পালন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করছে।
প্রেস ফ্রিডম মুক্ত গণমাধ্যম রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস সাংবাদিকতা