ঢাকায় ‘ফেরা, না ফেরা’ নিয়ে শ্রমিকরা উভয় সংকটে
৩ মে ২০২০ ২৩:২৫
ঢাকা: গ্রাম থেকে এখনও দলে দলে ফিরছেন পোশাক শ্রমিকরা। মালিকপক্ষের দাবি, এখনই শ্রমিকদের তারা গ্রাম থেকে আসতে নিরুৎসাহিত করছেন। তবে শ্রমিকরা বলছেন, চাকরি বাঁচাতেই তারা নগরীতে ফিরছেন।
এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের ফিরতে হলে তাদের সঙ্গে অফিসের পরিচয়পত্র থাকতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে দেখছেন সরকার ও মালিকপক্ষের দ্বিমুখী আচরণ হিসেবে। এর ফলে শ্রমিকদের আরেক দফা হেনস্তা বেড়েছে বলে মনে করছেন শ্রমিক নেতারা। আর খোদ পোশাক কারখানার মালিকরাই মনে করছেন, কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে শ্রমিকরা এখন উভয় সংকটে পড়েছেন। সরকার ও মালিকপক্ষের সামঞ্জস্যহীন সিদ্ধান্ত পোশাক শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সমতুল্য বলেও মন্তব্য এসেছে কারও কারেও কাছ থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি কোনো গাইডলাইন ছাড়াই চালু হয়েছে দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেও কারখানার নিরাপত্তা বিষয়ে এখনো কোনো গাইডলাইন তৈরিই করতে পারেনি সরকারি প্রতিষ্ঠান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাধারণ নির্দেশকা ও বিজিএমইএ’র গাইডলাইনে চলছে এসব পোশাক কারখানা। তবে সেখানেও স্বাস্থ্যবিধির পুরোটা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রোববার (৩ মে) কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পোশাককর্মীদের ঢাকায় প্রবেশ করতে হলে সঙ্গে অফিসের পরিচয়পত্র থাকতে হবে। আবার মালিকরা বলছেন, শ্রমিকদের এখনই ঢাকায় প্রবেশ করতে হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও কিছুদিন আগে পোশাককর্মীদের আর ঢাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
জানতে চাইলে চাইলে বাংলাদেশ বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সালাউদ্দিন স্বপন সারাবাংলাকে বলেন, কলকারখানা অধিদফতরের এ ঘোষণা সরকারের দ্বিমুখী নীতির প্রতিফলন। এটি শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। তারা একবার শ্রমিদের ঢাকায় আসতে বলছে, আবার আরেকবার বলছে ঢাকায় আসতে হবে না। যারা ঢাকায় কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই তাদের ঢাকার বাসায় আইডি কার্ড রেখে গেছেন। এখন গ্রামে থাকায় তারা তো আর ঢাকায় ঢুকতে পারবেন না।
কলকারখানা অধিদফতরের ওই প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশনাকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক অভিহিত করে তিনি বলেন, এর ফলে শ্রমিকদের নতুন করে হয়রানির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা এখন পদে পদে হয়রানি হচ্ছে। সরকার-মালিক ইচ্ছা অনুযায়ী ঘোষণা দিচ্ছে। শ্রমিকদের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না। কলকারখানা অধিদফতর থেকে একটি গাইডলাইন হওয়ার কথা। এখনো তা হয়নি। অথচ গার্মেন্টস চলছে পুরোদমে। সবমিলিয়ে শ্রমিকরা এখন জীবন ও অর্থনীতি— দুই দিক দিয়েই হুমকিতে আছে। একদিকে কারখানায় ছাটাই হচ্ছে, লে-অফ হচ্ছে; অন্যদিকে বিজিএমইএ ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এগুলো না করতে। কিন্তু প্রায় সব কারখানায় কমবেশি ছাটাই হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি সারাবাংলাকে বলেন, সীমিত আকারে গার্মেন্টস চালু করার কথা, কিন্তু এখন সব গার্মেন্টসই প্রায় পুরোদমে চালু হয়ে গেছে। কাখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন জোরদার করা হয়নি। এখন আবার বলছে আইডি কার্ড ছাড়া শ্রমিক ঢাকায় ঢুকতে পারবে না। এটা সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক হলেও শ্রমিকের জন্য নয়। শ্রমিক ছাড়া যেন কেউ ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সরকার সেজন্য এটি করেছে। কিন্তু শ্রমিকদের এখন ঢাকায় আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই চিঠির ফলে শ্রমিকরা আরও বেশি করে আসতে বাধ্য হবে। কারখানায় কোনো শ্রমিক যদি সংক্রমিত হয় কিংবা কোনো পোশাককর্মী সংক্রমিত হয়, তাহলে কারখানার মালিককেই এর দায়ভার নিতে হবে।
তিনি বলেন, নিয়ম না মেনে কোনো কারখানা চললে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা এখনো বলা হয়নি। কিন্তু ওই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকা উচিত।
ময়মনসিংহের একাধিক পোশাক শ্রমিক সারাবাংলাকে জানান, কারখানা থেকে এখন আর ফেরার জন্য তাদের কল দেওয়া হচ্ছে না। বরং চাকরি বাঁচাতে তারা নিজেরাই স্বেচ্ছায় কাজে ফিরছেন। কারণ কাজে যোগ না দিলে তাদের চাকরি থাকবে না বলে আশঙ্কা করছেন।
সাভারের একটি কারখানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পোশাককর্মী সারাবাংলাকে বলেন, ‘অল্প কিছু লোক দিয়ে আমাদের ফ্যাকটরি চালু করেছে। গ্রামে থাকায় ফোন দিয়ে জানিয়েছে, এখন আসতে হবে না। পরিস্থিতির উন্নতি হলে পুরোদমে ফ্যাকটরি খোলা হবে। ৭ তারিখের পর মনে হয় ফ্যাকটরি খুলতে পারে।’ তিনি বলেন, পুরোদমে কাজ চালুর পর সাভারের দু’টি কারখানায় শ্রমিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পর এখন ওই কারখানাগুলো বন্ধ আছে।
মালিবাগের একটি কারখানার শ্রমিক বলেন, কারখানা বেশ কয়েকদিন ধরেই খোলা। সোমবার (৩ মে) ঢাকায় ফিরেছি। আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। কয়েক জায়গায় আইডি কার্ড দেখাতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, রাস্তায় যারা আসছে, তারা সবাই কি পোশাককর্মী? আমরা তো নতুন করে কারখানায় কাউকে ঢুকতে দেখি না। শ্রমিকরা যখন ঢাকার বাইরে গেছে, তখন কিন্তু কোনো নিউজ হয়নি। যখন আসছে, তখনই সবাই উঠে-পড়ে লাগে। আমরা যখন মার্চের ২৭/২৮ তারিখের দিকে ছুটি দিই, তখনও কিন্তু লকডাউন ছিল। আমরা তাদের কর্মস্থলে থাকতে বলেছিলাম। শ্রমিকরা কেন যাচ্ছে, কেন আসছে সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। যখন মার্চের বেতন দিয়েছি, তখনো আবার তারা গ্রামে চলে গেছে। আমরা কারখানার আশপাশের সীমিত শ্রমিক দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। নতুন করে কেউ এলেও তাকে কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। কর্মস্থলে আসার পর ১৪ দিন কোয়ারেনটাইন করে তাকে কাজে প্রবেশ করতে বলা হচ্ছে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, যারা কারখানায় আসেনি, তাদের এখন আসতে আমরা নিরুৎসাহিত করছি। আমরা কম শ্রমিক দিয়ে কাজ করছি। কলকারখানা অধিদফতর যে নির্দেশনা দিয়েছে, শ্রমিকদের ঢাকায় আসতে উৎসাহিত করা যাবে না। তবে মালিকপক্ষের বক্তব্য ও কলকারখানা অধিদফতরের নির্দেশনা তো সাংঘর্ষিক বটেই। এমন প্রেক্ষিতে উভয় সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শ্রমিক যেহেতু আমাদের, আমরা এখনো তাদের বলছি, জোরজবরদস্তি করে কাজে আসবেন না। আর কিছুদিন ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছি। যানবাহন চালু হলে তারপর কাজে ফিরুন।
এসব বিষয়ে জানতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায়কে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী আজমকেও কল করে পাওয়া যায়নি।
কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর কারখানা খোলা পোশাক কারখানা পোশাক শ্রমিক বিজিএমইএ