নকল এন-৯৫ মাস্ক: জেএমআই’কে বাঁচাতে প্রকাশ হচ্ছে না প্রতিবেদন?
৪ মে ২০২০ ১২:৫৪
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব শুরু হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) থেকে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হয় চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ও মাস্কসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। এসব সরঞ্জামের মধ্যে বড় একটি অংশের এন-৯৫ মাস্ক ছিল নকল। সেগুলো সরবরাহ করেছিল বেসরকারি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপ।
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের পর ওই কমিটি এরই মধ্যে এই নকল এন-৯৫ মাস্ক বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে জমা হওয়ার পর পাঁচ দিনেও প্রকাশিত হয়নি সে প্রতিবেদন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘অধিকতর যাচাই-বাছাই’ ও ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র করতে গিয়েই এখনো প্রতিবেদনটি প্রকাশ পায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতেই কি প্রতিবেদন প্রকাশে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে?
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের জন্য নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের খবর প্রকাশ পেলে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। গত ২১ এপ্রিল এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. সাইদূর রহমান শুক্রবার (১ মে) সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের তদন্ত আগেই শেষ হয়েছে। আমরা গত ২৮ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন জমাও দিয়েছি মন্ত্রণালয়ে। সেটি কেন প্রকাশ পায়নি, সে বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।
সাইদূর রহমান জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। তবে প্রতিবেদনে কোনো সুপারিশ করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, হ্যাঁ, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা হয়েছে। এটি ২৮ এপ্রিল জমা হয়েছে বলে শুনেছি। এখন এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে। এরপরই এই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
‘যেহেতু প্রতিবেদনটি এখন স্বাস্থ্য সেবা সচিবের কাছে আছে, তাই এ বিষয়ে অন্য মন্তব্য করা ঠিক হবে না,— বলেন হাবিবুর রহমান খান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এন-৯৫ মাস্কের সরবরাহের জন্য জেএমআই গ্রুপের কাছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল কি না, জেএমআই গ্রুপের এন-৯৫ মাস্ক তৈরি বা বিতরণের অনুমোদন আছে কি না— এ বিষয়গুলো ছিল তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। এছাড়াও মাস্ক সরবরাহে কোনো ধরনের জালিয়াতি বা দুর্নীতি করা হয়েছে কি না, সে বিষয়টিও প্রাধান্য পায়। তবে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিলেও তা প্রকাশ করতে গড়িমসি কেন, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।
তদন্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) পরিচালক (ভাণ্ডার ও সরবরাহ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, কমিটি আমাদের এখানে তদন্ত করে গেছে। এটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
মাস্ক সরবরাহ বিষয়ে সিএমএসডি’র কোনো ভুল হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কোনো ভুল পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ আমাদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অর্ডারই দেইনি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর আয়োজিত ব্রিফিংয়েই আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছিলাম।
এদিকে জেএমআই গ্রুপের পক্ষ থেকেও তদন্ত বিষয়ে মন্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, কমিটি আমাদের এখানে সবকিছু তদন্ত করে গেছেন। যেহেতু প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি, তাই এটা নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো।
তবে যার কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সেই সচিব আসাদুল ইসলামের মোবাইল নম্বরে দুই দিন ধরে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার নম্বরে বারবার এসএমএস পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিকিৎসক জানান, তদন্ত শেষ হওয়ার পরেও রিপোর্টের ফলাফল প্রকাশ না হওয়ার কারণ হতে পারে একটাই। আর তা হলো মাস্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত জেএমআই কে বাঁচানোর একটা প্রয়াস চালানো।
এদিকে, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ বা এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে কাজও শুরু করেছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫৩৬ জন চিকিৎসক নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিস (এফডিএসআর)। নিম্ন মানের মাস্ক ও পিপিই সরবরাহের কারণেই চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।