করোনার সংক্রমণ শনাক্ত-চিকিৎসা নিয়ে বিশৃঙ্খল চট্টগ্রাম
৪ মে ২০২০ ২২:০০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা, এর ফলাফল এবং সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার আগে উপসর্গ থাকা রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ, সিভিল সার্জন, হাসপাতাল ও নমুনা পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এখন দৃশ্যমান।
নমুনা সংগ্রহের পর কমপক্ষে সাত দিনের আগে পরীক্ষার ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যেই সন্দেহভাজন আক্রান্তদের কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার ফল আসার আগে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকলে কাউকে ভর্তি করা হচ্ছে না। ফলে নমুনা সংগ্রহ ও শনাক্তের মাঝের সময়টুকুতে দিব্যি সবার সঙ্গে মিশছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করোনার সামাজিক বিস্তৃতির ঝুঁকি বাড়ছে।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে দ্বিগুণের বেশি কাজ করছেন তারা। সক্ষমতা না বাড়ালে সমন্বয়হীনতা ঘোচানো অসম্ভব। আর চট্টগ্রামে জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত চিকিৎসকরা বলছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রামে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হবে।
চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজে (বিআইটিআইডি) গত ২৬ মার্চ থেকে এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনার অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটিতে (সিভাসু) গত ২৫ এপ্রিল থেকে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়। বিআইটিআইডি থেকে পাঠানো নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে সিভাসুতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রোববার (৩ মে) পর্যন্ত চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে চার হাজার ছয় জনের। প্রতিদিন প্রায় সাতশ থেকে আটশ নমুনা পরীক্ষার জন্য আসছে বিআইটিআইডিতে। দু’টি ল্যাব মিলিয়ে পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২৫০। এজন্য বিআইটিআইডিতে নমুনার জট তৈরি হয়েছে।
গত ২৭ এপ্রিল বিআইটিআইডিতে ১২ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এর মধ্যে শুধু সিএমপির একজন পুলিশ সদস্য ছাড়া বাকি ১১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয় সাত দিন আগে। পুলিশ সদস্যের নমুনা একদিন আগে সংগ্রহ করে পরদিনই ফল দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন বিআইটিআইডি ও সিভাসু’র ল্যাব থেকে যেসব ফল আসছে, তার নমুনা নেওয়া হয় কমপক্ষে সাত দিন আগে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর গ্রামের এক অসুস্থ নারী গত ২১ এপ্রিল নগরীর আগ্রাবাদে মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ওই দিন তার নমুনা নেওয়া হয়। ২৭ এপ্রিল পরীক্ষায় তিনি করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন। কিন্তু এর মধ্যে তিনি বাড়ি ফিরে যান এবং আত্মীয়স্বজনরা সবাই তাকে দেখতে আসেন। কিন্তু করোনা পজিটিভ হওয়ার পর সবাই ঝুঁকিতে পড়ে যান।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকায় ১৬টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। আর আমাদের হচ্ছে মাত্র দু’টি ল্যাবে। সেই দু’টি ল্যাবে সক্ষমতার দ্বিগুণ কাজ হচ্ছে। এর বেশি কোনোভাবেই সম্ভব না। সক্ষমতার তিন গুণ বেশি নমুনা আসছে প্রতিদিন। মাত্র দু’টি ল্যাবে কি এত নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব? সেজন্য ছয়-সাত দিন সময় লেগে যাচ্ছে। কিন্তু যাদের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, আমরা তাদের বারবার বলছি যে আপনারা ঘরে থাকুন, কোয়ারেনটাইনে থাকুন। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। তারা এলাকায় গিয়ে সবার সঙ্গে মিশছেন। এতে অবশ্যই ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।’
করোনা মোকাবিলায় গঠিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একটি ল্যাব প্রস্তুত হয়েছে। ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি পিসিআর মেশিন আনা হয়েছে। সেখানে প্রায় একটি নমুনা প্রতিদিন পরীক্ষা করা যাবে। সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলার নমুনা কক্সবাজারের ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। আশা করছি, এ সপ্তাহের মধ্যেই চট্টগ্রামে নমুনাজট আর থাকবে না।’
শুধু নমুনাজট নয়, নমুনা পরীক্ষার ফল নিয়েও চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। রোববার (৩ মে) রাত ১২টায় বিআইটিআইডিতে ১৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেন সিভিল সার্জন। পাশাপাশি সিভাসুতে ৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়। সিভাসুতে আট জন পজিটিভ পাওয়া যায়, যাদের চার জন নোয়াখালীর এবং চার জন লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা হিসেবে জানান সিভিল সার্জন সেখ ফজেলে রাব্বি ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির।
কিন্তু সোমবার সকালে আগের রাতের ফল সঠিক নয় জানিয়ে সিভিল সার্জন তথ্য দেন, সিভাসুতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত আট জনের প্রত্যেকেই চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দা। এদের মধ্যে দু’জন দামপাড়া পুলিশ লাইনের। এছাড়া পাঁচলাইশ এলাকার একজন চিকিৎসক। নগরীর সরাইপাড়ার একজন, রেয়াজুদ্দিন বাজার এলাকার একজন, গোসাইলডাঙ্গা এলাকার একজন এবং বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এলাকার আছেন দু’জন। আগের রাতে ঘোষিত ফলাফলে একজন যে মৃত আছেন, তার বিষয়েও সঠিক কোনো তথ্য ছিল না সিভিল সার্জনের কাছে।
জানতে চাইলে সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দু’টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। একেকটির ফল একেকসময় আসছে। সেজন্য কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে ফলাফল দিতে গিয়ে সমন্বয় থাকছে না।‘
এছাড়া সাত দিন ধরে আটকে থাকা নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার সময় শনাক্তদের সঠিক ঠিকানা অনেক সময়ই দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। অথচ আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের পর ওই রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া, বাড়ি-এলাকা লকডাউন করাসহ সার্বিক দায়িত্ব বর্তায় পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ওপর। সঠিক ঠিকানা না পাওয়ায় এক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে।
এদিকে নমুনা পরীক্ষার আগে করোনার উপসর্গ থাকা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডিতে করোনা পজিটিভ অথবা সুনির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকলে কাউকে ভর্তি করা হচ্ছে না। অথচ চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তদের অনেকেরই কোনো লক্ষণ নেই।
চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত ১২ জন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে আট জন ট্রাফিক বিভাগের। নগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রাফিক সদস্যদের মধ্যে প্রথম শনাক্ত হওয়া একজন ছাড়া বাকিদের তেমন কোনো লক্ষণ নেই। কারও হালকা জ্বর ছিল, পরে আবার ভালো হয়ে গেছেন। কিন্তু পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ এসেছে।’
সোমবার (৪ মে) সকালে চট্টগ্রাম নগরীতে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ৪৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি বিদেশফেরত। অভিযোগ পাওয়া গেছে, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে একাধিকবার ভর্তির চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন। ২৮ এপ্রিল নমুনা সংগ্রহ করা হলেও সোমবার পর্যন্ত তার রিপোর্ট আসেনি। তাকে করোনা আক্রান্ত ধরে নিয়ে দাফনের নির্দেশ দেন সিভিল সার্জন।
নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসার আগে ভর্তি না করার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেনারেল হাসপাতালে এখন ৫২ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ৪০ জন আক্রান্ত ও ১২ জন সন্দেহভাজন। সুতরাং কাউকে ভর্তি নিচ্ছি না, এটা ভুল তথ্য। সামান্য শ্বাসকষ্ট থাকলেই তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে, কিডনি-ডায়াবেটিসের রোগীকেও পাঠাচ্ছে, আমরা কী করব? সবাইকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া কি সম্ভব? নমুনা পরীক্ষার রেজাল্টটা যদি তাড়াতাড়ি পেতাম, তাহলে আমাদের সুবিধা হতো।’
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে সত্যিকারভাবে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এর জন্য প্রথমেই দায়ী করব স্বাস্থ্য অধিদফতরকে। তারা চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছে না। এটার প্রমাণ হচ্ছে, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাকে হস্তক্ষেপ করে চট্টগ্রামের জন্য কিট আনতে হচ্ছে। আর চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্বলতা হচ্ছে, তারা সঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারছে না। কেউ ফ্লুতে আক্রান্ত হলেই তাকে করোনা পজিটিভ ধরে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ আসাই হাসপাতালে ভর্তির একমাত্র পূর্বশর্ত হতে পারবে না। চট্টগ্রামের এই যে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা, এটার উত্তরণ ঘটাতে না পারলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের চেয়েও পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।’
করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ চট্টগ্রাম নমুনা পরীক্ষা নমুনা পরীক্ষার ফল নমুনা সংগ্রহ নমুনাজট বিআইটিআইডি সিভাসু