Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিল্ডিং ‘লকডাউন-লাল নিশান’: করোনাকালের আরেক ‘ভুল’!


১০ মে ২০২০ ২৩:১৬

ঢাকা: মো. শহীদুল্লাহ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে বেঁচে ফেরা একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা। করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে বেঁচে ফিরলেও হৃদয়ে দারুণ এক ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তার। তবে সে ক্ষতের কারণ করোনার আক্রমণ নয়। কতিপয় নির্দয় প্রতিবেশী, আশপাশের কিছু ‘ভুল’ মানুষ এবং প্রশাসনের কিছু ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত তথা ‘লকডাউন‘ ও ‘লাল নিশান‘-ই তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ে নিদারুণ ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।

বিজ্ঞাপন

রেলওয়ে কর্মকর্তা মো. শহীদুল্লাহ পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর শান্তিনগরে। ভাড়া বাসায় নয়, নিজের বাসায়। সেই নিজের বাসায়-ই তিনি প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন পরিবার পরিজনসহ। তাদের অপরাধ? তারা ছিলেন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী! এখন অবশ্য সবাই সুস্থ।

ঘটনার সূত্রপাত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে! করোনার লক্ষণ নিয়ে আইডিসিআরে (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) নমুনা পরীক্ষা করান মো. শহীদুল্লাহ। পরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে। এরপর পরিবারের অন্য সদস্যদেরও পরীক্ষা করানো হয়। তাদেরও কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে। সবাইকে নিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শহীদুল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের যেদিন বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিনই ৩০ ফ্ল্যাটের ওই ভবনটি পুরোপুরি লকডাউন করে দেওয়া হয়। ফলে ভবনে থাকা বাকি ২৯টি পরিবারও জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়। তাদের বাজার-ঘাট, সাধারণ চলাফেরা, বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ একরকম বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বিল্ডিংয়ের অন্য বাসিন্দাদের রোষ ও ক্ষোভ গিয়ে পড়ে মো. শহীদুল্লাহ এবং তার পরিবারের ওপর।

মো. শহীদুল্লাহ’র ফ্ল্যাটের সুস্থ মানুষগুলোর সঙ্গে বিল্ডিংয়ের অন্য বাসিন্দারা শুরু করেন অমানবিক আচরণ। বাইরে বের হওয়া তো রীতিমতো বন্ধ। আত্মীয়-স্বজনেরা প্রয়োজনীয় বাজার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে চাইলেও মালিক সমিতির লোকজন বাধা দেন।

শুধু তাই নয়, হাসপাতালে যাওয়ার সময় মো. শহীদুল্লাহ এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যরা বিল্ডিংয়ের গলিপথ দিয়ে হেঁটে গেলেন কেন? তাদেরকে ‘প্যাকেট মুড়ে’ নেওয়া হলো না কেন?—এ ধরনের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় খোঁজ-খবর নিতে আসা স্বজন ও পরিবারের সুস্থ সদস্যদের! এমনও প্রশ্ন তোলা হয়, শহীদুল্লাহ’র ফ্ল্যাটের জানালা কেন দিন-রাত বন্ধ রাখা হচ্ছে না? দরজা-জানালায় বার বার কেন ডিজইনফেকট্যান্ট স্প্রে করা হচ্ছে না?

বিজ্ঞাপন

টানা ৯/১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর কোভিড-১৯ নেগেটিভ রিপোর্ট আসার খবর বিল্ডিং মালিক সমিতির কানে পৌঁছায়। তখন তারা শহীদুল্লাহকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, হাসপাতাল ছেড়ে পরিবার নিয়ে উঠবেন কোথায়? আপনার জন্য তো আর ৩০টি পরিবার ঝুঁকি নিতে পারে না। আপনি ক’টা দিন অন্য কোথাও থাকার চেষ্টা করেন!

প্রতিবেশীর এই নির্দয় আচরণে যখন অসহায় শহীদুল্লাহ পরিবার, তখন তারা হঠাৎ আবিষ্কার করেন, কে বা কারা ফ্ল্যাটের বারান্দার রেলিংয়ের সঙ্গে লাল নিশান টাঙিয়ে দিয়ে গেছে! ওই নিশানটা শহীদুল্লাহ পরিবারের সুস্থ সদস্যদের জন্য এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। সবসময় তাদের কাছে মনে হতে থাকে, আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন জানালার ফাঁক দিয়ে ওই লাল নিশানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর নিশানওয়ালা ফ্ল্যাটে যারা আছেন, তারা যেন আর মানুষ নন, ‘দেখার মতো একটা প্রাণী’তে পরিণত হয়েছেন।’

হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর মো. শহীদুল্লাহ জানতে পারেন, ওই লাল নিশান পুলিশেই টাঙিয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পর পরই পুলিশ এসে সেটি টাঙিয়ে দিয়ে যায়। সুস্থ হিয়ে ফিরে আসার পর ওই লাল নিশান পুলিশই আবার খুলে নিয়ে গেছে।

মো. শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগের দিনে কুষ্ঠ রোগীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হতো, তার চেয়েও অনেক খারাপ আচরণ করা হয়েছে আমাদের সঙ্গে। আমরা যেন অস্পৃশ্য! আমাদের সঙ্গে থেকে আমার মেয়ে আক্রান্ত হলো না, অথচ আমরা গলি দিয়ে হেঁটে গেলে সবাই আক্রান্ত হয়ে যাবে— এমন একটা ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হলো! আমাদের না জানিয়ে দরজার সামনে লাল নিশান টাঙিয়ে দেওয়া হলো! রীতিমতো আমাদের সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছিল! যেন আমরা বড় অপরাধ করে ফেলেছি ! এই দুর্বিষহ স্মৃতি আমরা ভুলতে চাই! কিন্তু ভুলতে পারছি না!’

শুধু শহীদুল্লাহর পরিবার নয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত  বেশিরভাগ ব্যক্তি এবং পরিবারের সঙ্গে একই রকম আচরণ করেছে প্রতিবেশীরা। আর এ আচরণের নেপথ্য কারণ, ওই ‘লকডাউন’ এবং ‘লাল নিশান’— এমনটই মনে করছেন মনোবিদ, সমাজবিজ্ঞানীরা।

তাদের মতে, একজন ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পর পুরো বিল্ডিং লকডাউন করা বা লাল নিশান টাঙিয়ে দেওয়া খুব একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নয়। আক্রান্ত লোকটাকে ফ্ল্যাট থেকে সরিয়ে ফ্ল্যাটটি প্রশাসনিকভাবে নজরদারি মধ্যে রাখা যেত। পুরো বিল্ডিংটি লকডাউন করায় বিল্ডিংয়ের অপরাপর পরিবারের ক্ষোভ-রোষ ওই আক্রান্ত পরিবারের ওপর গিয়ে পড়েছে। ফলে সামাজিকভাবে তাদের অনেকটা একঘরে করে রেখেছে সবাই।

অন্যদিকে লাল নিশান টাঙিয়ে সবার বাঁকা দৃষ্টি আক্রান্ত পরিবারের দিকে টেনে আনা হয়েছে। যেন এটি একটি ভয়ংকর ফ্ল্যাট, এদিকে কেউ আসবেন না। অর্থাৎ সবার থেকে আক্রান্ত পরিবারটিকে আলাদা করে দেওয়া এবং সমাজচ্যুত করার কাজটি সম্পন্ন করেছে ওই লাল নিশান। এটি একটি বিপদগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে গোটা রাষ্ট্র এবং সমাজের অমানবিক আচরণ হিসেবেই দেখছেন মনোবিজ্ঞানীরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মনোবিদ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরিই করোনাভাইরাস বিস্তার রোধের হাতিয়ার। যেহেতু বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সচেতনতা তৈরির কাজটি কঠিন, তাই লকডাউনের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে দুয়েকজন ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার কারণে পুরো বিল্ডিং লকডাউন সত্যিই অস্বস্তিকর। তারপরও এটার বিপক্ষে বলা যাবে না। কারণ, চলমান পরিস্থিতিটা আমাকে বুঝতে হবে। তবে লাল নিশান টাঙিয়ে দেওয়াটা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য না। এটা কারা করেছে? পুলিশ প্রশাসন, নাকি প্রতিবেশী? যারাই করুক, ঠিক করেনি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. খায়রুল আলম সারাবাংলাকে, ‘এ সিদ্ধান্ত আমাদের না। স্থানীয় প্রশাসনের। আর এটা তো (লাল নিশান) ভালোর জন্যই করা হয়েছিল। মানুষ যেন ভয়ে ওদিকে না যায়! কিন্তু ঘটল তো উলটা! বিল্ডিং লকডাউন দেখার জন্য মানুষের ভিড় জমাতে শুরু করল। তবে এটা ঠিক, আক্রান্ত পরিবারের জন্য লকডাউন-লাল নিশান অবশ্যই অস্বস্তিকর। কিন্তু আমাদের তো মাস পিপলের কথা ভাবতে হচ্ছে।’

করোনাভাইরাস করোনায় আক্রান্ত কোভিড-১৯ বিল্ডিং লকডাউন রেলওয়ে কর্মকর্তা লাল নিশান

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ইনজুরিতে মৌসুম শেষ রদ্রির
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২৮

সম্পর্কিত খবর