করোনাভাইরাস: ১০ সপ্তাহ শেষেও সংক্রমণ-মৃত্যু বাড়ছেই
১৮ মে ২০২০ ১০:১৫
ঢাকা: ৮ মার্চ ২০২০। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়লো দেশে। এরপর গুনে গুনে ১০টি সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এখনো দেশব্যাপী আতঙ্ক হয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস। শুধু তাই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন এর সংক্রমণের মাত্রাও বাড়ছে। ১০ সপ্তাহের পরিসংখ্যান বরং বলছে, প্রতি সপ্তাহেই আগের সপ্তাহের চেয়ে আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছে করোনাভাইরাস।
গত শনিবার (১৬ মে) ১০ সপ্তাহ পূরণ হয় দেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের। সেদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিং থেকে জানানো হয়, ১০ সপ্তাহ শেষে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ২০ হাজার ৯৯৫ জন শনাক্ত হয়েছেন। আর করোনাভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন ৩১৪ জন। সবশেষ রোববারের তথ্য অনুযায়ী সংক্রমণ শনাক্তের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন আরও এক হাজার ২৭৩ জন, মৃতের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন আরও ১৪ জন।
প্রথম ৫ সপ্তাহে সংক্রমণ শনাক্ত ৭০
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শুরুর দিকে এই ভাইরাসের সংক্রমণের গতি ছিল একেবারেই ধীর। যত সময় পার হয়েছে, ততই বেড়েছে সংক্রমণের গতি। ৮ মার্চ যে প্রথম ৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়, ওই দিন থেকে হিসাব করলে প্রথম সপ্তাহে (৮ মার্চ থেকে ১৪ মার্চ) আর কারও শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি।
এরপর দ্বিতীয় সপ্তাহের ঠিক প্রথম দিন, ১৫ মার্চ গিয়ে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন আরও দু’জন। ওই সপ্তাহে (১৫ মার্চ থেকে ২১ মার্চ) মোট ২১ জনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তৃতীয় সপ্তাহে (২২ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ) এই সংখ্যা ছিল আরও তিন জন বেশি— ২৪ জন। চতুর্থ সপ্তাহে (২৯ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল) সংক্রমণ একটু কমেও যায়। সে সপ্তাহে ২২ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন নমুনা পরীক্ষায়। চার সপ্তাহ মিলিয়ে সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৭০টি।
পঞ্চম সপ্তাহ থেকে গতি পায় সংক্রমণ
সপ্তাহভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চতুর্থ সপ্তাহের তুলনায় পঞ্চম সপ্তাহে (৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল) সংক্রমণের গতি হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। চতুর্থ সপ্তাহে যেখানে ২২ জন করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছিলেন, সেখানে পঞ্চম সপ্তাহে এই সংখ্যা ছিল ৪১২! এরপর প্রতিটি সপ্তাহেই এমন উল্লম্ফনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। যেমন ষষ্ঠ সপ্তাহে (১২ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল) সংক্রমণ শনাক্ত এক লাফে পেরিয়ে যায় দেড় হাজার— সংখ্যাটি ছিল এক হাজার ৬৬২।
একই ধারাবাহিকতায় সপ্তম সপ্তাহে (১৯ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল) সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২ হাজার ৮৫৪টি, অষ্টম সপ্তাহে (২৬ এপ্রিল থেকে ২ মে) ৩ হাজার ৭৯২ ও নবম সপ্তাহে (৩ মে থেকে ৯ মে) এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৯৮০। সবশেষ দশম সপ্তাহে (১০ মে থেকে ১৬ মে) ৭ হাজার ২২৫টি কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় সারাদেশে।
সংক্রমণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে
পঞ্চম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। তথ্য বলছে, এই বৃদ্ধির হারটি খুব সুখকর নয়। ষষ্ঠ সপ্তাহেই যেমন পঞ্চম সপ্তাহের তিন গুণ বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। সপ্তম সপ্তাহে সংক্রমণ শনাক্ত হয় আগের সপ্তাহের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। পরের দুই সপ্তাহে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩২ ও ৩১ শতাংশ। আর সবশেষ দশম সপ্তাহে আগের সপ্তাহের তুলনায় ৪৫ শতাংশ সংক্রমণ বেড়েছে।
সংক্রমণ শনাক্তের হারও বাড়ছে
পঞ্চম সপ্তাহ থেকে গতি পাওয়ার পর নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের হারও ঊর্ধ্বগতির ধারাবাহিকভাবে ধরে রেখেছে। পঞ্চম সপ্তাহে ৫ হাজার ৫৩৮টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ৪১২টি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওই সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। পরের সপ্তাহে ১২ হাজার ৮৭৮ নমুনার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্ত হয় ১ হাজার ৬৬২টি— সংক্রমণের হার ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ।
পরের তিন সপ্তাহে এই হার ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ০১ শতাংশ, ১ দশমিক ৭২ শতাংশ ও ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ সপ্তম সপ্তাহে কিছুটা বাড়লেও অষ্টম সপ্তাহে কিছুটা কমে আসে শনাক্তের হার। নব্ম সপ্তাহে সেটা আরও বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত তথ্য বলছে, দশম সপ্তাহে ৫০ হাজার ৩৭৫টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ৭ হাজার ২২৫টি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। অর্থাৎ সংক্রমণের হার ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। একক সপ্তাহ হিসেবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে এটিই সংক্রমণ শনাক্তের সর্বোচ্চ হার।
শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়া কেন উদ্বেগজনক
নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সামনের সপ্তাহগুলোতে সংক্রমণ শনাক্তের পরিমাণ লাগামহীনভাবে বাড়বে, এটি পরিসংখ্যানই বলছে। কারণ স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও বেশি বেশি করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের সে চেষ্টা সফল হলে নিশ্চিতভাবেই সামনের দিনগুলোতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। এখন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার স্থিতিশীল থাকলে সংখ্যা বেশি হলেও করোনার সংক্রমণের গ্রাফটি থাকবে স্থিতিশীল। সংক্রমণের গতি বাড়ছে না, সেটিরই পরিচায়ক হবে সেই গ্রাফটি। কিন্তু এই হার বাড়তে থাকলে নমুনা পরীক্ষা যত বেশি বাড়বে, সংক্রমণ শনাক্তের পরিমাণ তার চেয়েও বেশি হারে বাড়বে।
আচমকা মৃত্যুর পরিমাণ সপ্তাহে ১০০
৮ মার্চ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হলেও দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির প্রথম মৃত্যুর ঘোষণাটি আসে ১৮ মার্চ। ওই সপ্তাহেই ২১ মার্চ মারা যান আরও একজন। অর্থাৎ প্রথম সপ্তাহে কোনো কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু না থাকলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে দু’জনের মৃত্যু হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে এই সংখ্যা ছিল ৩ জন করে। সংক্রমণ শনাক্তের মতো মৃত্যুর ক্ষেত্রেও চতুর্থ সপ্তাহে একে উল্লম্ফন দেখা যায়। ওই সপ্তাহে ২২ জন কোভিড-১৯ রোগী মারা যান দেশে।
এরপর পঞ্চম ও ষষ্ঠ সপ্তাহে যথাক্রমে ৫৪ জন ও ৫৬ জন কোভিড-১৯ রোগী মারা যান। মৃত্যুর হার এ পর্যায়ে ছিল বেশ আশঙ্কাজন। তবে পরের দুই সপ্তাহে করোনাজনিত মৃত্যুর পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। অষ্টম সপ্তাহে ৩৫ ও নবম সপ্তাহে ৩৯ জন মারা যান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে।
আর সবশেষ দশম সপ্তাহে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মতো মৃত্যুর সংখ্যাও আগের সব পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যায়। এই সপ্তাহে মোট একশ জন মারা যান, যা এর আগের সর্বোচ্চ সপ্তম সপ্তাহের (৫৬ জন) তুলনায়ও প্রায় দ্বিগুণ!
সপ্তম ও দশম সপ্তাহে কেন সংক্রমণ বেশি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে, সংক্রমণ গতি পাওয়ার পর সপ্তম সপ্তাহে আগের সপ্তাহের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি ব্যক্তি সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত হন। এর পরের দুই সপ্তাহে এর পরিমাণ ৩০ শতাংশের আশপাশে নেমে এলেও দশম সপ্তাহে তা ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়। শুধু তাই নয়, এই দুই সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হারও যেকোনো সপ্তাহের তুলনায় বেশি (১৩ দশমিক ০১ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ)। এই দুই সপ্তাহে সংক্রমণ বেশি হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণেই কি সংক্রমণ বেশি ছিল?
এ বিষয়ে জানতে চাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেনের কাছে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বিভিন্ন কারণেই এটি হয়ে থাকতে পারে। তবে সংক্রমণ বেশি তখনই হবে, যখন বেশি বেশি মানুষ এই ভাইরাসের সামনে ‘এক্সপোজড’ হবেন।
সপ্তম ও দশম সপ্তাহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে বলে মনে করেন ডা. মুশতাক। তিনি বলেন, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে পোশাক শ্রমিকদের ঢাকায় আসা এবং ফিরে যাওয়ার মতো কিছু ঘটনা ছিল। ওই সময় অনেক মানুষ এই ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন। আবার মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই অনেক কিছু শিথিল হয়ে পড়ে। ফলে এই সময়ে আবার অনেকে এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে একটু বেশি পড়েছেন। এই সময়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতি বেশি থাকায় হয়তো আসলে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন।
নমুনা পরীক্ষা বাড়লে সংক্রমণ বাড়বে?
তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যতই সময় গড়িয়েছে, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে সংক্রমণের পরিমাণও। ফলে নমুনা পরীক্ষা কোভিড-১৯ সংক্রমণে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে কি?
জানতে চাইলে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, টেস্ট বাড়ালে সংক্রমণ বাড়তে পারে, এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে যদি সংক্রমণ শনাক্তের হার না বাড়ে, সেক্ষেত্রেও নমুনা পরীক্ষা বাড়ালে সংক্রমণের পরিমাণ বাড়বে। তবে সেটি স্থিতিশীল মাত্রায়। এরকম পর্যায়ে গেলে তারপরই হয়তো সংক্রমণ কমবে। তবে আমাদের এখানে সংক্রমণ শনাক্তের হারই বাড়ছে। এই প্রবণতা থাকলে একই পরিমাণ টেস্ট করালেও আগের চেয়ে বেশি কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হবে।
সামনে আরও বেশি নমুনা পরীক্ষার সুযোগ তৈরি করতে স্বাস্থ্য অধিদফতর কাজ করছে বলে সারাবাংলাকে জানালেন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের ৪১টি ল্যাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা চলছে। আরও বেশ কয়েকটি ল্যাবে কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোও নমুনা পরীক্ষায় যুক্ত হবে। আমরা যত বেশিসম্ভব ল্যাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করাতে চাই। সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।