করোনায় অনলাইনেও জমেনি ঈদের কেনাকাটা
১৯ মে ২০২০ ১০:০৭
ঢাকা: দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রম রোধে খোলা হয়নি বেশিরভাগ শপিং মল। যে কয়েকটি শপিং মল খোলা রয়েছে, সেগুলোতেও ভিড়-বাট্টা নেই বললেই চলে। এ পরিস্থিতিতে ধারণা করা হচ্ছিল, অনলাইনে ঈদের শপিং হয়তো জমবে এবার। কিন্তু ই-কমার্স সাইটের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের পরিস্থিতিও একইরকম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেলিভারি বন্ধ থাকায় অন্যান্য ঈদের চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিক্রি কম রয়েছে। ফেসবুকভিত্তিক পেজগুলোরও একই অবস্থা।
দেশে ই-কমার্স সাইটের সংখ্যা কত, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই কারও কাছে। খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই সংখ্যা হাজার দুয়েক। এর বাইরে ফেসবুক মার্কেটিংয়ের মাধ্যমেও অনলাইনে বিকিকিনি চালাচ্ছেন হাজারও উদ্যোক্তা। এসব সাইট ও ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে প্রসাধনী সামগ্রী, পোশাক— বিক্রি হয় সবই। কিন্তু বর্তমানে প্রায় হাজার খানেক সাইটই বন্ধ রয়েছে বলে জানাচ্ছেন ই-কমার্স সংশ্লিষ্টরা। বলছেন, বেশিরভাগ সাইটে স্টকে থাকা পুরোনো পণ্য বিক্রি হচ্ছে। তবে গত কয়েকদিন হলো তারা পুরোদমে বেচাকেনা শুরু করতে পেরেছেন।
ফেসবুকে হ্যান্ডমেইড শাড়ি, পাঞ্জাবি ও বাচ্চাদের কাপড় বিক্রির একটি পেজ ‘রংধনু ক্রিয়েশন’। এর উদ্যোক্তা শাহনাজ সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, করোনার প্রথম দিকে বেচাকেনা ছিল না বললেই চলে। রোজা শুরু হওয়ার পর রেসপন্স ভালো। তারপরও সবসময় যেমন বিক্রি হয়, বা অন্য ঈদে যেমন বিক্রি হয়, তেমন হচ্ছে না।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শাহনাজ বলেন, অন্য ঈদে ২৫ পিস অর্ডার পাওয়া গেলে এখন ১৫ পিস পাওয়া যাচ্ছে। বৈশাখে ছিল মাত্র ৩ থেকে ৪ পিস।
এক প্রশ্নের উত্তরে এই উদ্যোক্তা জানান, বাচ্চাদের পোশাকের প্রতি মানুষের আগ্রহ এখন সবচেয়ে বেশি। নিজেরটা না কিনলেও সবাই শিশুদের পোশাক কিনছে। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের বড় একটি অংশ অনলাইনকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে করছেন শাহনাজ।
কাতান, বেনারসি, সুতি কাপড় ও শাড়ি বিক্রেতা পেজ ‘অংশু’। এর উদ্যোক্তা তানজিলা হক সারাবাংলাকে বলন, করোনার কারণে নতুন কোনো পণ্য আসেনি। আমরা এখন পুরোনো পণ্যই বিক্রি করছি। পুরোনো স্টক থেকে বিক্রিও ভালো হচ্ছে। হোম ডেলিভারিতে তেমন কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। যদি কোনো বাসায় ফ্ল্যাটে যেতে ঝামেলা হয়, তবে ক্রেতাকে নিচে নেমে আসতে বলা হয়।
তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে একেবারেই বেচাকেনা বন্ধ ছিল। এখন কিছুটা হচ্ছে। তবে অন্য ঈদের তুলনায় বেচাকেনা কম। উৎসবেই আমাদের বেশি বেচাকানা হয়, এবারও হচ্ছে। তবে সেটা অন্যবারের মতো নয়।
‘কইন্যা’ নামক একটি ফেসবুক পেজের উদ্যোক্তা বাঁধন মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ডেলিভারি এখন আগের মতো ইজি নেই। আগে যেমন সহজ-সাবলীল ছিল, এখন আর তা নেই। স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচেনা করে মার্চ থেকেই আমাদের কারখানা বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল অনলাইনও। এখন শুধু পুরাতন কাস্টমারদের জন্য অনলাইন ডেলভারি চালু করেছি। প্রপারলি ডেলভারি হচ্ছে না। অনেক বিল্ডিংয়ের নিচে বাইরের লোক অ্যালাউ করছে না। এই সময়ে পণ্য ফেরত আসাও রিস্কি। তাই বুঝে শুনে পুরাতন কিছু ক্রেতাদের অনুরোধে অনলাইন ডেলিভারি চালু করেছি। সেক্ষত্রে পুরোনো ড্রেসের ডিমান্ড রয়েছে, কারণ ঈদে সবাই নতুন জামা চায়।
ই-কমার্স সাইট বাগডুমের চেয়ারম্যান শামীম আহসান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের সাইটে পিপিই, কুটির শিল্প ও আড়ংয়ের পণ্য এখন বিক্রি হচ্ছে। জরুরি পণ্যগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। ওভারঅল সব প্রোডাক্ট যাচ্ছে না। শখের জিনিষিপত্র কম বেচাকেনা হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বিক্রি বেশি।
আজকের ডিল’র সিইও ফাহিম মাশরুর সারাবাংলাকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বিক্রি কম। দেশের অনেক এলাকায় আমরা ডেলিভারি দিতে পারছি না। গ্রামগঞ্জে ডেলিভারি বন্ধ রয়েছে। তবে আমাদের কাছে প্রচুর অর্ডার রয়েছে। আর পোশাক আশাকের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। তবে গত বছরের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে।
দারাজের এমডি সৈয়দ মোস্তাহিদল হক সারাবাংলাকে বলেন, বেশিরভাগ ব্যবসা বন্ধ। করোনার পর থেকে বর্তমানে বেচাকেনা কিছুটা বাড়ছে। এখন অনেক ক্রেতাই আসছেন। বেশ ভালো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে। গ্রোসারি বা অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য তো আগে থেকেই বিক্রি হচ্ছিল, সেগুলো এখনও চলছে। জামা-কাপড় বা ফ্যাশন আইটেমেই এখন বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে অন্যান্য ঈদের চেয়ে এবার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেচাকেনা কম।
ঈদ শপিং নিয়ে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাবি, ছেলেদের টি-শার্ট ও নারী পুরুষের বিভিন্ন ধরনের পোশাক আইটেম, কসমেটিক্স আইটেম, জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য এবার বিক্রি হচ্ছে। দর্জি বাড়ি, সারা লাইফস্টাইল, আন্তর্জাতিক চেইন ব্র্যান্ড স্প্ল্যাশ, ইগনট, রাইজ এমনকি দেড়শ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ক্রোকোডাইল এবং বাটাসহ দেশের স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের পণ্যও ছিল ঈদ ক্যাম্পেইনে। এছাড়াও ঈদের মতো উৎসবে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ভারী হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য কিনে থাকেন। যেমন— টিভি, এসি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি। সেসব গ্রাহকদের কথা বিবেচনায় নিয়ে এসব পণ্যের বিভিন্ন ব্র্যান্ডে আমরা শতভাগ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকসহ বিভিন্ন অফার রেখেছি।
তিনি আরও বলেন, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এখন যেহেতু করোনার কারণে ঘরে বাইরে যাওয়া উচিত নয়, তাই ঈদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা গ্রোসারি আইটেম কেনাকাটায় থাকছে ইভ্যালি এক্সপ্রেস শপ। এছাড়াও ইভ্যালিতে থাকছে স্বপ্ন সুপার শপ। ২০ শতাংশ মূল্যছাড় পর্যন্ত অফারে এখানে গ্রাহকেরা তাদের ঈদের মুদি বাজার করতে পারেন।
এছাড়া দেশের স্বণামধন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড তাদের পণ্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা রেখেছে, যদিও তা নগরকেন্দ্রিক। জুতার ব্র্যান্ড এপেক্স এমটিবি’র ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে কেনাকাটা করলে ১২ শতাংশ ক্যাশব্যাক দিচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ড এমন ভিন্ন ভিন্ন অফার রয়েছে। অনলাইন কেনাকাটায় প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশও ছাড় দিচ্ছে। তবে এপেক্স এখন শুধু ঢাকার ভেতরেই ডেলিভারি দিচ্ছে, আর ঢাকার বাইরে কয়েকটি স্থানে ছোট পরিসরে। জুতোর আরেক ব্র্যান্ড বাটাও অনলাইনে কেনাকাটার সুযোগ দিচ্ছে। আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে একই ব্যবস্থা রয়েছে।
জানতে চাইলে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল সারাবাংলাকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে অনলাইনে কেনাবেচো তেমন নেই। আগের চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেচাকেনা কমে গেছে। এখনো অনেক সাইট বন্ধ রয়েছে। বেশিরভাগ সাইটেই নতুন পণ্য নেই। অনেকে নতুন পণ্য উৎপাদনে যেতেও পারেনি। মানুষ এখন আসলে ঈদের আমেজে নেই। অনেকের চাকরি চলে যাচ্ছে। তবে ডিজিটাল বায়ার তৈরি হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে ক্রেতা বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।