পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভে ‘উসকানি’ দেখছে মালিকপক্ষ
২০ মে ২০২০ ২৩:৩০
ঢাকা: ঈদের আগে বেতন ও বোনাসের দাবিতে গত কয়েক দিন ধরেই দেশের বেশকিছু পোশাক কারখানায় বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ঘটনা ঘটছে। কোথাও কোথাও শ্রমিকরা ভাঙচুর চালিয়েছেন বলেও মালিকপক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও শ্রমিকদের ‘উসকানি’ দিয়ে বিক্ষোভ করানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে মালিকপক্ষের।
গত কয়েকদিনের ধারবাহিকতায় বুধবারও (২০ মে) দেশের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। সকালে পোস্তগলায় সিভিক অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করেন। মালিবাগে ড্রাগন সোয়েটারের শ্রমিকরা বেতন ও বোনাসের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। বৃহস্পতিবার (২১ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাদের বিক্ষোভ করার কথা রয়েছে।
সারাদেশের পোশাক কারখানায় শ্রম অসন্তোষের শঙ্কার কথা খোদ মালিক পক্ষের বক্তব্যেই উঠে আসছে। বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ভাঙচুরের প্রতিবাদে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। দুই সংগঠনের সভাপতি রুবানা হক ও এ কে এম সেলিম ওসমানের সই করা এক যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঈদকে সামনে রেখে গত ক’দিন ধরে বেতন ভাতা আন্দোলনের নামে যেভাবে পোশাক কারখানায় ভাঙচুর করা হচ্ছে, তাতে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে গভীর উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি চলমান থাকলে কারখানাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এসব ঘটনার পেছনে বহিরাগতের উসকানিও দেখছে মালিকপক্ষ। তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে দুই সংগঠনের সভাপতি।
মালিবাগের ড্রাগন সোয়েটারের শ্রমিক ও কর্মচারীরা সারাবাংলাকে জানান, সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত তারা বিক্ষোভ করেছেন। বিভিন্ন সময়ের আন্দেলনের পরিপ্রেক্ষিতে ও ঊর্ধ্বতন মহলের চাপে কারখানাটি কুমিল্লায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই কারখানা আচমকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। তারা বলছেন, ঈদের আগে তাদের বেতন ও বোনাস দেওয়া হয়নি। বেশকিছু শ্রমিকের বকেয়া রয়েছে কারখানাটিতে।
সারাবাংলা ডটনেটেও এই কারখানায় বেতন-ভাতার সমস্যা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বুধবার আন্দোলন করায় শ্রমিকরা পুলিশের হয়রানির শিকার হচ্ছে বলেও অভিযোগ এসেছে। আন্দোলকারী কয়েকজন শ্রমিককে হাতিরঝিল থানা থেকে ফোন দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে এই কারখানার শ্রমিকরা বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করবেন বলে জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সারাবাংলাকে বলেন, গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের প্রায় সব জায়গাতেই বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকরা বেতন ও বোনাসের দাবিতে আন্দোলন করছেন। আশুলিয়ার হ্যাংডং কারখানার শ্রমিকরাও বিক্ষোভে নামেন। এখনো ৪০ শতাংশ পোশাক কারখানায় এপ্রিল মাসের বেতন বাকি রয়েছে। আর ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কারখানার শ্রমিকরা এখনো বোনাস পাননি বলে দাবি করেন এই শ্রমিক নেতা।
বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, বিভিন্ন কারখানায় বেতন-বোনাস দেওয়া হচ্ছে। ঈদের দিন পর্যন্ত বোনাস দেওয়া চলবে। তবে পোস্তগলার সিভিক অ্যাপারেলসহ দেশের অনেক কারখানাতেই এখনো বেতন-বোনার হয়নি। এসব কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ কারখানায় শ্রমিকদের এপ্রিল মাসের বেতন হয়েছে এবং ৬০ শতাংশ কারখানায় বোনাস দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, অনেক জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে। শ্যামপুর, পোস্তগলার সিভিক, মালিবাগে ড্রাগন সোয়েটার, রেদওয়ান, কালিয়াকৌরে রিপট নিট কোয়ালিটি ফ্যাশনসহ বিভিন্ন কারখানায় আন্দোলন হচ্ছে। এখনো কারখানাগুলোর বড় একটি অংশে এপ্রিল মাসের বেতন হয়নি। কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে শতভাগ বোনাস আদায় করে নিয়েছেন। এখন আমরা বলতে গেলে দোষ হয়। শিল্প পুলিশও তো বলছে, অর্ধেক কারখানায় এখনো বেতন হয়নি। ড্রাগন সোয়েটার ট্রান্সফার করে নিচ্ছে, বোনাস দেয়নি। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে, বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ভাঙচুরের বিষয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ প্রতিবাদ জানিয়েছে। দুই সংগঠনের সভাপতি রুবানা হক ও সেলিম ওসমানের সই করা যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে বেতন-বোনাস ইস্যুতে কারখানা ভাঙচুরের কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ সরকার, মালিক ও শ্রমিক— ত্রিপাক্ষিক সিদ্ধান্তের আলোকে কারখানাগুলো সংকটের মধ্যে থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করে ভেতন-ভাতা পরিশোধ করছে। কিছু কিছু কারখানায় অবশ্য এর ব্যত্যয় ঘটছে। কারণ এই কারখানাগুলোর অনেকের হাতেই এখন কাজ নেই। তারপরও কারখানাগুলো এ বিষয়ে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো— ত্রিপাক্ষিক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেতন ও বোনাস পরিশোধ করা সত্ত্বেও অনেক কারখানা ভাঙচুরের সম্মুখীন হচ্ছে, যা শিল্পের জন্য অশনি সংকেত এবং এটি ভবিষ্যতে উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নিরুৎসাহিত করবে বলে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ মনে করে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গতকাল পর্যন্ত ডিবিএল, ওপেক্ষ মেডলার, ইমপ্রেস, ভিশন, ডিজাইনটেক্স, সেনটেক্স, সিভিক অ্যাপারেলস লি ও ফকির নিটওয়্যারসহ অনেক পোশাক কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে। বেলিসিমা ও সিভিক অ্যাপারেলসের মালিকদেরকে সরাসারিভাবে অপদস্থও করা হয়েছে, যা একান্তভাবে অনভিপ্রেত। এসব আইন বহির্ভূত ঘটনায় বহিরাগতদেরও উসকানি রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি চলমান থাকলে কারখানাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ বলছে, এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতি ও ভাঙচুরের কারণে কারখানা ও ব্যবসা বন্ধ হলে মালিক-শ্রমিক— উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে লাখো শ্রমিক ভাইবোন কর্মহীন হয়ে পড়বেন। এতে করে সার্বিক অর্থনীতি পিছিয়ে পড়বে। সেইসঙ্গে সামাজিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হবে, যা মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন হবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ জাতীয় অর্থনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় লিপ্ত দুষ্কৃতকারীদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে কঠিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ ও জোর দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেও জোরালো পদক্ষেপ একান্তভাবে আশা করছে পোশাক কারখানার মালিকদের শীর্ষ দুই সংগঠন।
পোশাক কারখানা পোশাক শ্রমিক পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন বেতন-বোনাস বেতন-বোনাসের দাবিতে আন্দোলন