করোনা পরীক্ষায় অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে ইনসাফ বারাকা হাসপাতাল
২৬ মে ২০২০ ১৫:৫৯
ঢাকা: রাজধানীর ইনসাফ বারাকাহ কিডনি ও জেনারেল হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার টাকা করে। সরকার নির্ধারিত নমুনা সংগ্রহের জন্য ৫০০ টাকা ও নমুনা পরীক্ষার জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটিতে রোগীর কাছ থেকে আলাদাভাবে নেওয়া হচ্ছে নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রীর দামও। এছাড়া এক সপ্তাহ আগে বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষা করালেও রোগীদের কাছ থেকে নিয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা।
১৯ মে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে দেশের ১৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে নমুনা পরীক্ষা করার অনুমতি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরটি পিসিআর মেশিন আছে বলে জানানো হয়। এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে কেউ নমুনা পরীক্ষা করালে তার খরচ ৩ হাজার ৫০০ টাকা হবে বলেও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে বাসায় গিয়ে নমুনা আনলে ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, যেসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে আরটি পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে কোভিড-১৯ পরীক্ষার সুবিধা নেই তাদের নমুনা সমূহ অনুমতি প্রাপ্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে আলোচনার ভিত্তিতে পরীক্ষা করবে। সেক্ষেত্রে সেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নিতে পারবে বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
কিন্তু জানা গেছে, ১৯ মে’র আগে ইনসাফ বারাকাহ কিডনি ও জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হতো। সে সময় নমুনা পরীক্ষা করানো হতো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনে (নিপসম)। নিপসমে বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষা করা হলেও ইনসাফ হাসপাতালের পক্ষ থেকে রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে।
সম্প্রতি হাসপাতালটিতে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষা করানো হয় রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন পাওয়া ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিসিআর ল্যাবে।
সম্প্রতিকালে ইনসাফ হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করাতে যান জাফর চৌধুরী (ছদ্মনাম) দম্পতি। এখানে তাদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করার সময় দুটি বিলের কপি দেওয়া হয়। একটি বিলের কপিতে ৪ হাজার টাকা নেওয়া হয় ও আরেকটি বিলের কপির মাধ্যমে ১ হাজার টাকা নেওয়া হয়। সর্বমোট ৫ হাজার টাকা নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে।
এই দুই বিষয়ে ইনসাফ হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে প্রথম দিকে এই প্রতিবেদকের জানতে চাওয়া হয়, আপনি কোথা থেকে জেনেছেন?
প্রতিবেদকের কাছে নমুনা পরীক্ষার কাগজ আছে জানানো হলে পুরো বিষয়টি স্বীকার করে নেয় এক কর্মকর্তা। এরপরে অকপটে সব স্বীকার করে নিলেও অফিসিয়াল মন্তব্যের জন্য বলে হাসপাতালের ডিএমডির সঙ্গে কথা বলার জন্য।
হাসপাতালের ডিএমডি আলতাফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, হ্যাঁ আমরা প্রথম দিকে টাকা নিতাম নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য। সে সময় আমরা নিপসমে পরীক্ষা করাতাম। আমাদেরকে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বলা হয়েছিল।
কিন্তু নিপসমে পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করানো হলেও আপনারা টাকা নিয়েছেন। এমনটা কেনো? প্রশ্নের জবাবে আলতাফ হোসেন বলেন, ‘প্রথমদিকে আসলে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা ছিল না টাকা পয়সা সংক্রান্ত বিষয়ে। আর তাই টাকা নেওয়া হয়েছে। তবে এ টাকা মূলত আমাদের টেকনোলজিস্ট, চিকিৎসক ও অন্যান্য খরচ বাবদ নেওয়া হয়েছে যার মধ্যে যাতায়াত খরচ ও নমুনা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা সোয়াপ স্টিকের দাম অন্তর্ভুক্ত।‘
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান আলতাফ মাহমুদ। কিন্তু ২৯ এপ্রিল যে তিনটি বেসরকারি হাসপাতালের ভর্তি থাকা রোগীরা কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরীক্ষা করার অনুমতি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর তাতে ছিল না ইনসাফ হাসপাতালের নাম।
জাফর চৌধুরীর নমুনা পরীক্ষার সময়ে নেওয়া ৫ হাজার টাকা বিষয়ে আলতাফ মাহমুদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে নমুনা পরীক্ষার খরচ ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে নমুনা সংগ্রহের জন্য ৫০০ টাকা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। এর পাশাপাশি আমরা নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রীর জন্য ১ হাজার টাকা করে নিয়ে থাকি। এইক্ষেত্রে আমরা মাস্ক, গ্লাভস ও গাউনের খরচ নিয়ে থাকি রোগীদের কাছ থেকে।
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে তো পিপিই খরচ নিতে বলা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমরা যদি চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য আলাদাভাবে পিপিইর দাম নেই তবে সেটা কী দোষের কিছু?’
সরকারিভাবে তো পিপিইর দাম নিতে বলা হয়নি। সেক্ষেত্রে আপনারা যেটা নিচ্ছেন সেটাকে অনৈতিক ভাবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না এটাকে আমরা অনৈতিক ভাবছি না।’
আপনারা যে মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করছেন তা কী শুধুমাত্র একবারই করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আলতাফ মাহমুদ বলেন, ‘হ্যাঁ, সেগুলো একবারই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।’
আগে যিনি নিপসমে নমুনা নিয়ে যেতেন সেজন্য আপনারা তার জন্য গাড়ি ভাড়ার বিষয়ে বলছেন। এজন্য রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা বলছেন। তাহলে কী প্রতিটা রোগীর জন্য আলাদাভাবে তিনি সেই প্রতিষ্ঠানে যেতেন নাকি একবারেই যেতেন? এক্ষেত্রে তাহলে এটার টাকাও কী রোগীর কাছ থেকেই নেওয়া হবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ প্রতিবারই আলাদাভাবে যেতো সকল রোগীর ক্ষেত্রে। একটা ছেলে কষ্ট করছে তার সিএনজি নিয়ে যেতেও তো একটা গাড়ি ভাড়া দিতে হয়। তাই না?’
হাসপাতালে কতজন টেকনোলজিস্ট কাজ করছেন এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে এইচআর বিভাগ বলতে পারবেন। আমি বলতে পারছি না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর আপনাদের নমুনা পরীক্ষা করার অনুমতি দিয়েছিল ১৯ মে’র আগে এমন কোনো পত্র দেখাতে পারবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে সেটাতো হাসপাতালে। এখন সেটা আমার কাছে নেই। তাই আমি আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপ বা মেইলে সেটা দিতে পারবো না।’
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ইতোমধ্যেই দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য। সেক্ষেত্রে তারা রোগীর কাছ থেকে নমুনা পরীক্ষার জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং অন্যান্য খরচ বাবদ ৫০০ টাকা নিতে পারবেন। এর বাইরে যদি কোনো টাকা পয়সা নেওয়া হয়ে থাকে তবে সেটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। আমরা এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেবো।’
রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষা করানো বিষয়ে ডা. আমিনুল হাসান বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় আমাদের জানা নেই। খবর নিয়ে জানাতে হবে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ইতোমধ্যেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর বাইরে যদি কোনো টাকা পয়সা নেওয়া হয়ে থাকে তবে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবো।’
উল্লেখ্য, ২৯ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতাল (আগের নাম অ্যাপোলো হাসপাতাল), স্কয়ার হাসপাতাল ও ইউনাইটেড হাসপাতাল— এই তিনটি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীরা কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরীক্ষা করতে পারবে সেখানেই। এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রতিষ্ঠান কেবল নমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় কিটের দাম রাখবে। সাধারণত এই কিটের দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়া আরও কিছু সেটআপের জন্য খরচ হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পরীক্ষার খরচ সাড়ে ৩ হাজার টাকা ঠিক করে দিয়েছি।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগের রোগীদের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগে আসা রোগীদেরও নমুনা পরীক্ষা করা হবে। সেটা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হবে। কারণ এখানে যে ল্যাব আছে, তাতে টেস্টিং কিটসহ অন্যান্য সরঞ্জাম আমরা সরবরাহ করব। তারা শুধু পরীক্ষা করে দেবে।’
ঢাকার বাইরে আরও কোনো হাসপাতাল কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমতি চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতর তা বিবেচনা করবে বলেও জানান অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাইরে যেসব হাসপাতাল এই পরীক্ষা করতে সক্ষম, তারা আমাদের কাছে আবেদন করবেন। আমাদের টিম গিয়ে তাদের ল্যাব পরিদর্শন করবেন। পরিদর্শনে তাদের ল্যাব অনুমোদন পাওয়ার উপযোগী হলে অনুমোদন পাবে। আমরা অনুমোদন দিতে প্রস্তুত।’
পরবর্তীতে ১৯ মে ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতাল (সাবেক অ্যাপোলো হাসপাতাল), স্কয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, পুর্নাভা হেলথ বাংলাদেশে লিমিটেড, ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ডিএমএফআর মলিকিউলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক, ল্যাব এইড হাসপাতাল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স জেনারেল হাসপাতাল ও কেয়ার মেডিক্যাল কলেজকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়।
এছাড়া রাজধানী ঢাকার বাইরে বগুড়ার টিএমএসএস মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড রাফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতাল ও চট্রগ্রামের শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি (পিটিই) লিমিটেডে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করানোর বিষয়ে জানানো হয়।